স্মৃতির সরণি থেকে তুলে আনা কিছু উদাসী মুহূর্ত
🍁
তৈমুর খান
🍁
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে “The heart that truly loves never forgets.” অর্থাৎ যে হৃদয় সত্যিকারের ভালোবাসে তা কখনো ভুলে যায় না।এই সত্যিকারের ভালবাসার টান অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের ‘অলীক স্বপ্ন ও সিল্যুয়েট'(কলকাতা বইমেলা ২০২৩) কাব্যগ্রন্থখানি পাঠ করেই বুঝতে পারলাম। মোট ৫১ টি কবিতা নিয়ে এক সহজ ও সহজাত সারল্যে ভরপুর কাব্যটি আমাদেরও নস্টালজিক করে তোলে। পুরো কাব্যটিতেই আছে জীবনের আখ্যান, টুকরো টুকরো নানা স্মৃতির বারান্দা,উপলব্ধির করতলে স্পর্শ করার আনন্দ,ফিরে দেখা অতীত জীবনের স্নেহ পরবশ মুহূর্তগুলিকে,যার মধ্যে কবি নিজেই উপস্থিত হয়েছেন।নিজের মুখোমুখি নিজেই দাঁড়িয়েছেন।কখনো শূন্যতায়,কখনো ইঙ্গিতে,কখনো বেদনায় নিজেকে চালিত করেছেন।অকৃত্রিম হৃদয়ের বাঁশিতে সুর ঝরিয়েছেন।তারপর বহুদূর হেঁটে এসে দার্শনিকের মতন নির্মোহ দৃষ্টি নিয়েই দৃষ্টিপাত করেছেন:
“মনে হয় জীবন তো বিহঙ্গের ডানা
সময় ভেঙে ভেঙে যেন চলে যায়
পড়ে থাকে দৃশ্য চিহ্ন
বিরহী বাতাসে থাকে অনন্ত দুঃখকথা
ঝরে পড়ে শিলাপতনের শব্দ”
গতিশীল জীবনের এই উড়ন্ত অভিরূপ এবং একে একে বিহঙ্গের ডানার মতো সব স্মৃতির ঝরে পড়া নিয়েই এগিয়ে চলা তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কবি ঝরে পড়া ডানাগুলিকেই কুড়িয়ে নেন আর উড়ানের স্নেহপরাগে রঙিন হয়ে ওটাকে কবিতার শব্দে ছন্দিত নন্দিত বন্দিত করে তোলেন।আর তা করতে গিয়েই অনুভব করেন:
“উড়ছে ভাঙছে আবার মেঘ পথে উড়ছে
পা ফেলি ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতার ভেতর
যেতে যেতে হাত মুঠো করি আবার খুলি
এসে যায় একবিন্দু ঠিক যেন বৃত্ত”
জীবনের এই চলার গতি বৃত্ত হয়ে আবর্তিত হয়। নিজেকে হারিয়ে ফেলার মধ্য দিয়েও এক কৌতূহল জেগে ওঠে।তাই কবির অপেক্ষাও শেষ হয় না।
‘মনে পড়ে’ দুটি শব্দেই বোঝা যায় অতীতের এই স্বপ্ন ও শূন্যতার কথা। স্মৃতির সুতো ধরে আমরাও সেখানে পৌঁছে যাই। কিছুটা সুখ, ভালোলাগা,প্রেম-রোমেন্সের ছায়াছন্ন পথে মন কেমন করে ওঠে।সম্পর্ক গড়ে ওঠা,সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ঋতুর খেলায় আমরাও পর্যবসিত হই।কিন্তু হৃদয়ের তাগিদে কিছুই অস্বীকার করতে পারি না।বহুদিন পরও সেই অতীত নিয়ে,সেই অ্যালবামের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে যাই। নিজের কিশোরবেলার দেখা আকাশ, নিজের ছুটোছুটি খেলাধুলা, পাঠশালা,ভাবনা সবই একসঙ্গে ফিরে আসতে থাকে। নিজের প্রথম চিনতে শেখা রবীন্দ্রনাথকেও মনে পড়ে যায়। তারপর অলকানন্দার কাছাকাছি গেলে নিজের জীবন সীমানাকেই পরিমাপ করতে পারি:
“সুবর্ণচর জুড়ে অলকানন্দা
তবুও এক বিষণ্ণতা নিয়ে কৃষ্ণমাটির হৃদয়
জীবন গড়িয়ে গড়িয়ে যেন এক মরুদ্যান
অথচ পাখিবিল জুড়ে সবুজ অরণ্য
ঠোঁটে ঠোঁট সোহাগে সোহাগে”
প্রকৃতিও যেন প্রেমালাপে মিশে যায়,জীবন মহিমার রসদে পূর্ণ করে দেয়। যার নিস্তব্ধতা আছে।যার বেহালার রাগের সুরনির্ঝরতা আছে। যার মহাজাগতিক তরঙ্গ আছে।
ইতালীয় সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক, দার্শনিক এবং সংকেত বিশ্লেষক উমবার্তো একো ও এম আর আই (১৯৩২-২০১৬) বলেছেন
“We are always remaking history. Our memory is always an interpretive reconstruction of the past, so is perspective.”
অর্থাৎ আমরা সর্বদা ইতিহাস পুনর্নির্মাণ করি। আমাদের স্মৃতি সবসময় অতীতের একটি ব্যাখ্যামূলক পুনর্গঠক, তাই দৃষ্টিকোণও।”
অতীতের এই ভাবনা দিয়েই ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করেছেন অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ও।যদিও তাঁর শূন্যতার কাছে বারবার অবহন করেছেন তবু বাল্যের একটি পৃথিবী যেন থেকে গেছে।কবি তাঁর সংলাপে বলেছেন:
“অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে
যাওয়া জীবনের গল্পগুলো এসে যায়
ভাবতে থাকি ঠিকানাবিহীন কোনো চিঠি
মেঘের ভেতর ভাসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করি,
কি রে কেমন আছিস? আসলে এসবই ভাবনা
পরিপূর্ণতা পায় না…”
এই ভাবনারই ইমারত গড়ে উঠেছে ‘অলীক স্বপ্ন ও সিল্যুয়েটে’।কখনো পড়ন্ত বিকেলের কলোনির মাঠ,কখনো অরণ্যদ্বীপ,বৃষ্টিসন্ধ্যায় এই নিমগ্নতা আদায় করে নিয়েছে। বৃক্ষের বুকে অন্তর্ভেদী দুঃখে,অলীক স্বপ্নের মহাকাব্যিক উড়ানে তা বসতি স্থাপন করতে চেয়েছে। বর্ণপরিচয় পাঠশালা থেকে পাড়ি দিতে দিতে পলাশ উপত্যকার ঝরনায় কবি ভাসমান হয়েছেন।রাধাচূড়ার বিষণ্ণ সন্ধ্যায়, কখনো রোমান্টিক চোখের তারায়,সত্য বাউলের একতারায় নিজের উদাসী মুহূর্তকে খুঁজে পেতে চেয়েছেন।কাব্যের প্রতিটি শব্দাঞ্জলিতে তাই স্মৃতি-অঞ্জলির এক মগ্নতা দেখা দিয়েছে।পাঠকও খুঁজে পাবেন কবির ভাবনার মধ্যে নিজেকে।
🍁
অলীক স্বপ্ন ও সিল্যুয়েট:অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়,প্লাসেন্টা প্রকাশনী,প্রচ্ছদ অমর্ত্য বিশ্বাস,মূল্য ১৫০ টাকা। দূরভাষ ৯৪৩৩১৩৪৭৬১
ছবি: অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়

অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়


আলোচক ড. তৈমুর খান
তৈমুর খান