চারটি কাব্যের রিভিউ
চারজন কবির চতুর্মাত্রিক কাব্য

তৈমুর খান
চারজন কবির চারটি কাব্য চতুর্মাত্রিক ভিন্ন পথের দিশারী। কবিরা ভিন্ন বয়সের,ভিন্ন ভাবনার এবং ভিন্ন যাপনের শৈল্পিক প্রতিভাসে নিজেদের উপস্থাপন করেছেন। পাঠকের কাছেও তা কৌতূহলের উদ্রেক করবে।
১
সাতের দশক থেকেই বাংলা কবিতার জগতে পা রেখেছেন শশাঙ্কশেখর অধিকারী (জন্ম ১৯৪৯)। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘কত জ্যোৎস্না হেঁটে গেছে’ (প্রথম প্রকাশ কলকাতা বইমেলা ২০২৩) কাব্যগ্রন্থটি মোট ৮৭ টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। সহজ জীবনবোধের অনাড়ম্বর কবিতায় এক স্বচ্ছ সাবলীল বিষয়কেই তিনি অনুধাবন করতে চেয়েছেন। তিনি মনে করেন “আমার কাছে কবিতা এক একটি আলোর কণার মতো যা হৃদয়ের অন্তঃপুরকে উন্মোচিত করে তোলে।” সুতরাং আলংকারিকদের মতের সপক্ষেই সহৃদয় হৃদয়সংবাদি কাব্যের পথ অনুসরণ করেন।এই কাব্যের কবিতাগুলিতে এক আধ্যাত্মিক বোধের জাগরণ টের পাওয়া যায়। এই জগৎ-জীবন-সময়কে তিনি একই সরলরেখায় দাঁড় করিয়েছেন। অনন্ত জন্মের ভেতর এই জন্মকেও দর্শন করেছেন। তাই কবিতায় বলেছেন: “কত আলোকবর্ষ পেরিয়ে পথ চলা/অনন্ত আকাশের নিচে/কত জন্মের চড়াই-উৎরাই/ কত মৃত্যুর মাঠঘাট পেরিয়ে/কেউ কেউ প্রকৃত ঈশ্বরের দুয়ারে পৌঁছে যায়”। গোধূলির বেলা শেষে আধ্যাত্মিক বসন্তের এই হৃদয়বোধকে ধারণ করেই কবি ঈশ্বরের দুয়ারে পৌঁছে গেছেন। তাই তাঁর উচ্চারণে অনন্তের ইশারা জেগে উঠেছে। মহাজাগতিক তরঙ্গের স্পর্শ পেয়েছেন। সব প্রেমকে ব্রহ্ম প্রেমের সমীপে উত্তরণ ঘটিয়েছেন। শূন্যগর্ভ পূর্ণকুম্ভ হয়ে উঠেছে। মহাবিশ্ব সর্বভূতের ব্রহ্মআত্মায় বিস্তৃতি পেয়েছে।পার্থিব মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েও মহাজীবনের সম্মোহনকে কবি ধারণ করে অনির্বাণ জন্মবীজের দেখা পেয়েছেন। আর সেই কারণেই ওঁংকার অবগাহনে স্থিতপদ্ম তর্পণে সমাগত হয়েছেন।কবি অনুভব করেছেন “এক অপার্থিব জ্যোৎস্না/ নামছে পৃথিবীর নাভিমূলে”।এই আধ্যাত্মিক বোধই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় ঈশ্বরের সর্বব্যাপী মহিমায় পরিব্যাপ্ত। কবিও প্রস্তুতি নিয়েছেন ব্রহ্মে বিলীন হবার: “আমি তো গুছিয়ে রেখেছি যাবতীয় সাজ/ফিরে যেতে চাই শিকড়ের কাছে/বরাভয় সত্যের সন্ধানে”। এই সত্যের সন্ধানেই কবির বাণপ্রস্থ জীবনে নির্জনতা সঙ্গী হয়ে উঠেছে। সেখানে খণ্ডিত নয় এই জন্মও,বরং মহাজীবনের পরশে তা অনন্ত যাপনের প্রজ্ঞা।সব কবিতাগুলিতেই এই দার্শনিক চেতনার দেখা পাওয়া গেল।
২
কবি গৌতম রায়ের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘এ আমার প্রথম শ্বাস'(প্রথম প্রকাশ কলকাতা বইমেলা ২০২৩) কাব্যখানি মোট ৫৮ টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। গৌতম রায় অধুনান্তিক ভাবনার এক আত্মদর্শী কবি। তাই জীবনকে তিনি বহুমুখী প্রজ্ঞার আলোয় আবিষ্কার করতে চান। এই কাব্যটিতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিষয়ের ঊর্ধ্বে, বক্তব্যের বিপরীতে এবং উপলব্ধির স্বয়ংক্রিয় জাগরণে তাঁর কবিতায় এসেছে মুক্তির সোপান। মৃত কল্পনার কাছে স্বাভাবিক দৃশ্যগুলিও অতিচেতনায় অবাস্তব হয়ে উঠেছে। ক্রিয়া ও বিশেষণগুলি কার্যকারণের পথ পরিবর্তন করেছে। শব্দ ব্যবহারের চিরাচরিত রীতিপদ্ধতিও অবলম্বন করেননি। তিনি যেমন মেঘরোদের আত্মমুখী অভিমানকে নিজস্ব অনুজ্ঞায় চালিত করেছেন, তেমনি আলো-আঁধারির মৌনবেদনা বিছিয়ে রাখা গুমোটকে অশ্রুবিহীন তোলপাড় বালাসনের বাঁকে হর্নহীন পথ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শব্দজোড় সৃষ্টিতে এবং স্বাভাবিক বোধকে ভিন্নমাত্রায় চালিত করতে এই কাব্যধারা পাঠককে নতুন করে ভাবাবে।প্রচলিত সংস্কৃতি,ঐতিহাসিক মিথ এবং নান্দনিক জীবনধারাকে চেতলোকে কিভাবে তুলে আনেন তার একটি দৃষ্টান্ত এরকম: “শব্দভেদী বাণ যে ঘর বানায়/বুক দিয়ে স্নায়ু দিয়ে সাধনা দিয়ে নিজের করে নেয় বাউল,/বিচিত্র বর্ণিল আভরণের ভেতর বিরাজমান পূর্ণচন্দ্র কিংবা কার্তিক/তার আনন্দলহরী আঁজলায় আঁজলায় করি পান।
অমরত্ব বলে কিছু নেই।/ইলোরা অজন্তার সুফিয়ানা জন্ম দেয় নতুন বিজ্ঞান-বাউল/উত্তরপুরুষ গোছায় আঁতুড়ঘর।”
সভ্যতার ক্রমদর্শী জীবন প্রজ্ঞায় কবি এই নিবিষ্ঠ আত্মস্ফুরণকে একাসনে বসিয়েছেন। সেখানে বিজ্ঞান-বাউলে,আধ্যাত্মিকে সব ভেদ মুছে গেছে। কবি জানেন “বায়োলজিক্যাল পৃথিবী বিজ্ঞানের পায়ে পা ফেলে পার করে দেয় জন্মতোরণ”। শব্দজোড়ের নির্মাণে, চিত্রকল্পের ভিন্নতর প্রয়োগে,এবং বক্তব্যকে বক্তব্যহীন করে প্রয়োগ করাতে এই কবিকে চেনা সহজ। তিনি যখন লেখেন: ‘জলের আয়নায় ভেসে উঠছে/গর্ভবতী হস্তীমেঘ/প্রসব বেদনার ভার থেকে নির্ভার হতে মাতৃতোরণ থেকে বেরিয়ে আসছে সূর্যোদয়” তখন মহানির্বাণ প্রকৃতির অবচেতনিক ভোরের জাগরণ দেখতে পাই। তেমনি ”পাইন ঋষিপাহাড়ের আয়নার মুখোমুখি” দাঁড়ালে নিজেই অচেনা হয়ে যাই: “তিলোত্তমার মতো রূপের অবাক এসে দাঁড়ায়।” এই রূপের অবাকই এই কাব্যের হৃদয়। হ্যারল্ট পিটার উত্তর আধুনিকতাবাদ প্রসঙ্গে যে কথাটি বলেছিলেন:
“কোনটি বাস্তব এবং কোনটি অবাস্তব, এবং কোনটি সত্য এবং কোনটি মিথ্যা, তার মধ্যে কোনো কঠিন পার্থক্য নেই। একটি জিনিস অগত্যা সত্য বা মিথ্যা হয় না; এটা সত্য এবং মিথ্যা উভয় হতে পারে।” এই বিস্ময়ই এই কাব্যের মূল ধারণায় উঠে এসেছে। তাই ক্রম ভাঙার’ই প্রস্তুতি চলেছে সর্বত্র।
৩
কবি বিকাশ চন্দের ১২তম কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মের হৃদপিণ্ডে জীবন আঁকি'(প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ২০২৩) মোট ৫৬ টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। বিকাশ চন্দ এমন একজন কবি যিনি কবিতায় আত্মসন্ধানের নানা স্তরে অবগাহন করেন। জীবন,বেঁচে থাকা,জন্ম-মৃত্যু,ঈশ্বর এবং মানবিক সম্পর্কের এক রসায়নের মধ্য দিয়ে তিনি পাঠককে নিয়ে যেতে চান।সেখানে হয়তো রহস্য আছে, জ্যোৎস্নার আলো-আঁধারি আছে,ভাষা ও ভাষাহীনতা আছে, স্বপ্ন ও স্বপ্নের নিসর্গ আছে; কিন্তু এসব ছাড়াও জীবনের গৌরব এবং প্রাপ্তিকেও তিনি অস্বীকার করেন না। তাই একদিকে দেখেন ‘সহমর্মি রক্তবীজের অঙ্কুরোদগম’ যার মধ্যে ‘শস্যের সংলাপ’ থাকে। অপরদিকে ‘রাষ্ট্রনেতার ক্লেদাক্ত উষ্ণীষ’; যেখানে ‘দুচোখে চৈতন্যের শোক’,’গর্ভাধারে ভবিষ্যের অন্ধকার’। কবিতা যে অন্তর্মুখী এবং বহির্মুখীযাপনের এক প্রত্যয়ের উপর দাঁড়ানো তা বারবার তিনি বুঝিয়ে দেন। দৃশ্যের ভিতরও অদৃশ্যের সেই আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে: “আগুনের ভেতর ছায়ারা দুলছে অবিশ্বাস্য আত্মাহীন/বাতাসের নিঃশ্বাসে কুঁড়ি আলো মুখে পাঁপড়ি খোলে,/ বাতাসের বিদ্রূপ ধূলিসাৎ সংসার বোঝে সব / আমার বুকে এসো প্রাণের দোসর হৃদস্পন্দন শোনাবো।” এই ‘হৃদস্পন্দন’ তাঁর প্রতিটি কবিতাকেই করে তুলেছে হৃদয়ের কবিতা। ব্রিটিশ সোশ্যাল মিডিয়া খ্যাত তারকা ও ২২ বছর বয়সী কবি লাওরা চৌয়েট(Laura Chouette) কথিত ‘Poetry is the heart of the soul’ অথবা ‘My soul is made out poetry’. অর্থাৎ কবিতা আত্মার হৃদয়,অথবা আত্মাই তৈরি করেছে কবিতা—এই বক্তব্যেরই সমর্থন রয়েছে। তখনই কবি নির্দ্বিধায় লিখতে পারেন “রক্ত ঘামে লেখে জীবনের নাম।” বিষাদ মাদল বাজলেও “সমস্ত কথারা জুড়ে থাকে জীবন নির্জন কথকতায়”। কবি কবিতার নামই দেন ‘হৃদয়ে জন্মদেশ’। সেখানে যে বিনির্মাণ চলে তাতে “পিতৃ-পিতামহ আজও খোঁজে হৃদয় জন্মদেশ”। সুতরাং ‘লোলুপ আগুনের সাজানো প্রচ্ছদে’ যে “চতুর্দিকে অসহিষ্ণু জীবন তবুও বাজে পঞ্চমুখী শাঁখ”।এই পঞ্চমুখী শাঁখেই মর্মরিত ‘অপ্রতিহত জীবনযাত্রা’। মহার্ঘ্য শরীর ছুঁয়েই শৈশব কৈশোর যৌবনের প্রবাহ। অবিনশ্বর মহিমায় জন্ম নেয় অখণ্ড ঈশ্বর ও কবি।
৪
হাতে এসেছে কবি সাথি রায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ইচ্ছেরা ছুঁয়ে যায়..'(প্রথম প্রকাশ কলকাতা বইমেলা ২০২৩) । মোট ৫৬ টি কবিতা আছে এই কাব্যগ্রন্থে। সাহিত্যিক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের উত্তরসূরী এই কবি প্রথম কাব্যেই নিজেকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। মিতভাষী কবির কবিতাগুলি নির্মেদ ঝকঝকে উজ্জ্বল শিশির বিন্দুর মতো । একদিকে আত্মপ্রত্যয়ের স্নিগ্ধতা, অপরদিকে দার্শনিক চেতনার সূক্ষ্মবোধ বাগাড়ম্বরহীন সরাসরি প্রকাশ পাঠককে আকৃষ্ট করবে।নিজেই কবি উল্লেখ করেছেন : “ভাঙা আয়নায় মুখ দেখে দেখে/হইনি কখনো ক্লান্ত,/প্রত্যেক টুকরোয় দেখেছি আমি/জীবনের আদি-অন্ত।” কবিতার নাম ‘দর্শন’ ।এই দর্শনই মহাবীক্ষণ হয়ে উঠেছে কাব্যে।এই কবিতাগুলিই বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর অভিঘাত নিয়ে জেগে উঠেছে। কবি সেইখানেই রেখেছেন তাঁর ‘ভালোবাসা’: “প্রকৃতি যখন ক্যানভাস/আর রঙ-তুলিতে সুর,/নদী তখন গোপনে—/হয় সমুদ্দুর।” গুটিকয়েক শব্দে এই শানিত বোধের তীব্রতা অনেকখানিই নাড়িয়ে দিতে পারে। দাম্পত্য জীবনে যখন হাতের ওপরে হাত রাখতে হয় একসাথে চলার ব্রত নিয়ে,তখন এই কবি বলেন: “হাতের ওপর নাই বা আছে হাত/ মনের ঘরে তুমিই শক্ত ছাদ।”
আসলে মনের ঘরে ছাদ হওয়া যে কত কঠিন তা কেউ আর ভেবে দেখে না। তেমনি নোনা জলে বুক ভাসালে হৃদয় অনাথ হয়। প্রেমে-অপ্রেমের চাওয়া-পাওয়ার সব বর্ণমালাতেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। সব নদীই যে দু-কূল ভাঙে তা কবিরও জানা। প্রাত্যহিকের জীবনযাত্রা থেকে একান্ত অনুভূতিগুলি স্মৃতিশব্দে বারবার মথিত হয়েছে। কখনো শূন্যতা,কখনো নীরবতা,কখনো দূরত্ব মেপে জীবন চলেছে। ছন্নছাড়া ছন্দেই রাগ-বৈরাগ্য চার মাত্রার চলন পেয়েছে।কাচের টুকরো,গোলাপ কাঁটা,হৃদয়চেরা রক্তকালি সব নিয়েই এই অভিযাপন।কল্পনাগুলিও নেমে এসে জীবনের সঙ্গে খেলা পেতেছে। আবার হাওয়া এসে কল্পনা এঁকেছে। উপেক্ষাকে অপেক্ষায় পরিণত করেছেন। ঝাপসা কাচেই আরশি খুঁজেছেন। তাপ-অনুতাপ গড়িয়ে গেছে। মোহ-মায়ার কাছে জীবনকে দেখতে চেয়েছেন।রঙ্গমঞ্চে নিজের ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন। ‘সব বিকেলবেলার কবিতার জন্য’ নিজেকে নির্মাণ করেছেন। প্রতিটি ক্ষুদ্র কবিতায় উঠে এসেছে বৃহৎ জীবনের এক আকাশ দীপ্তি—সেখানে চেতনাকে বিছিয়ে দেওয়া যায়, জীবনের রংকে প্রকৃতির সঙ্গে মেলানো যায়, ভাষাকে সাংকেতিকতায় উচ্চারণ করা যায়, আবার নীরবতায় শুধু চেয়ে থাকাও যায়। বাংলা কাব্যজগতে স্বাগত জানাই কবি সাথি রায়কে।

১) কত জ্যোৎস্না হেঁটে গেছে: শশাঙ্কশেখর অধিকারী,উত্তরপাড়া, হুগলী-৭১২২৫৮, মূল্য ১৫০ টাকা।

২) এ আমার প্রথম শ্বাস : গৌতম রায়,ত্রিষ্টুপ প্রকাশনী, আর.সি-৪৫,রাস্তা ৩৩,অম্বুজা, সিটি সেন্টার,দুর্গাপুর-৭১৩২১৬,প্রচ্ছদ:গৌতম রায়,মূল্য ১৫০ টাকা।

৩) জন্মের হৃদপিণ্ডে জীবন আঁকি: বিকাশ চন্দ,কবিতিকা,রাজডাঙা মেনরোড,কলকাতার ১০৭,তুচ্ছ বিষ্ণু সামন্ত,মূল্য ১২০ টাকা।

৪) ইচ্ছেরা ছুঁয়ে যায়…: সাথি রায়,দি সীবুক এজেন্সি,২০১ এ মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট, কলকাতা- ৭, প্রচ্ছদ:রাজদীপ পুরী, মূল্য ১৫০ টাকা।








