সকলের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই অবশ্যই লাগে। সে ঠাঁই সকলের তো আর মার্বেল বসানো,বা এ, সি লাগানো হয় না ? বাঁচার তিনটি মূল বিষয় হল অন্ন, বস্ত্র আর বাসস্থান।
তাই প্রান্তিক মানুষের যেনতেন প্রকারেন একটা ঠাঁই তৈরি করতেই হয় মাটির দেওয়াল, ছিটেবেড়ার দেওয়ালে (বাঁশ দিয়ে) মাটি লেপে, না হলে কর্গেট শীটের বা অ্যাডবেস্টাসের আড় দিয়ে। কিছু না থাকলে ত্রিপল, চট বা পুরাতন কাপড় ঘিরে দিয়েও। মাথায় থাকবে পাকা ছাদের বদলে মাটির কোঠা, অ্যাডবেস্টাসের, টিনের, টালির বা খাপলরোল (গ্লাস টালি) ,পলিথিন বা তাল পাতার, হোগলার ছাউনি, না হলে নিদেন পক্ষে পলিথিনের আড়।
আমাদের পুরুলিয়া বাঁকুড়ায় মোটা মাটির দেওয়ালে খড়ের চাল গ্রীষ্ম কালে বেশ ঠান্ডা লাগে। যাকে বলে কুঁড়ে ঘর। পাকা বাড়ি তৈরির ভাবনা নুন আনতে পান্তা ফুরায় আরকি ? তবে এদানিং পাকা বাড়ি করার প্রবণতাই বেড়েছে। এই বাংলার কুঁড়ে বাড়ি থেকেই বাংলো নামের রূপান্তর। তবে বর্তমানে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। শহরে গজিয়ে উঠছে ফ্ল্যাট বাড়ি কালচার। তবুও প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে মানুষ কুঁড়ে ঘরেই বসবাস করেন। ঘরের চাল বানাতে হয় ধানের খড় দিয়ে।কাঠামো করতে হয় কাঠ, বাঁশ, রলা, মুধন, কড়ি বর্গা, দ বা পেলা, জুন দড়ি, বাঁশ বাতা বা ঝাঁটি ইত্যাদি। বছর তিনেক পর পর পঁচা খড় ঝেড়ে নূতন খড় চাপাতে হয়। একে বলে ঘর ছাওয়া। নূতন খড়ের অভাবে চালে পুরাতন খড় গুঁজে কাজ চালায়।
নূতন খড়ের চাল সোনালী রঙের ও ফোলা ফোলা হয়। পরে পরে রোদ জলে থেকে থেকে রঙ পাল্টে পাল্টে ছাই রঙ ধারন করে ও অনেকটা বসে যায় । নূতন খড় কে বাতার সঙ্গে বাঁধতে হয়। এজন্য বাবুই দড়ি বা জুন দড়ি, খড় বা পুয়ালের হাত পাকানো দড়ি ব্যবহার করতে হয়। দড়ি চালের এপার ওপার করতে একটা লম্বা সুঁচ লাগে, যা কামার ঘরে রড দিয়ে তৈরি করাতে হয় যার নাম ” তাল সুঁচ “। নূতন চালের বাড়ি নীচু হলে একটা সমস্যা হয় পথ চলতি গরু, বাছুর চাল টেনে খড় খায়। সে জন্য অনেক সময় কাঁটা, খেজুর পাতা বেঁধে রাখতে হয়। এডবেস্টাস, টালির চালে গরম বেশি লাগে। এই ধরনের চালে বাঁদর বা হনুমানের উপদ্রব অনেকে কাঁটা ডাল চাপিয়ে রাখে। না হলে চাল ফেটে যেতে পারে।
যে সমস্ত দক্ষ ব্যক্তি চালের কাঠামো বা ছাউনির কাজ করেন তাদের বলা হয় ঘরামি। আর যারা কাঠের কাজ করে তাদের বলে বাড়হই। সকলে এই কাজ মনে করলেই করতে পারে না। গ্রামের দু একজন পাকা ঘরামি হয়। ঘরামি চালের ওপরে প্রখর রৌদ্রে কাজ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, রৌদ্র মাথায় করে। মাটির দেওয়ালে কাঁইচি গুলো ধরে রাখতে কাঠের বা লোহার পেলা ও বাঁটালী জলই বা পেরেক লাগে।আগের দিনে বন থেকে ইংরেজি এল বর্ণের আকারের পেলাম কেটে আনা ছিল কাঠুরেদের কাজ। এখন লোহার তৈরি দোকানে পাওয়া যায়। যারা মাটির দেওয়াল তৈরী করে তাদের হাতে মাটি সইর বা সোজা করে কাটতে একটা কাঠের পাতলা টুকরা বা বাতা বা কাঠের ছুরি লাগে। মাটি হয় কররাইচ বা মোরাম।
কয়েক দিন আগের থেকে এই মাটি যাওন দিয়ে রাখতে হয়। পূর্ব মেদিনীপুরে ছিটে বেড়ায় মাটি এঁটেলের হয়। ও আগের থেকে মাটি যাওন দিয়ে রাখতে হয় তবে তারা সেই মাটিতে খড় কেটে টুকরো খড়, তুস, পাট কেটে কেটে টুকরো মিশিয়ে দেয়। যাতে দেওয়াল থেকে মাটি খসে না পড়ে। ছিটে বেড়ার ঘরে মাটির পলেপ খুব বেশি মোটা হয় না। ছিটে বেড়া ঘরে বাঁশের বাতায়ন বা সুন্দর ছোট বড় জানালা রাখা হয়। বাঁশের বাতার দরজাও তৈরি করে লাগানো হয়। বাঁশ ছেঁচে ছেঁচে বেড়ার বাতা তৈরি হয় বলে ছিটে বেড়া বলার চল।
এই খড়ের চাল সাধারণ চার বা এক বা দুই, চার চালের হয়। পুরুলিয়ায় খুব উঁচু চাল না হলেও কাঠের পাড়ন বা পাটাতন করে দোতলা করা হয়। একে বলে উপর কোঠা। ছোট জানালা রাখা হয়। জানালায় রডের বদলে বাঁশের বাতা বা লাঠি লাগানো হয়। জানালায় কোন দরজার প্রয়োজন হয় না।
বাঁকুড়ার দিকে টিনের বা এডবেস্টাসের চাল বেশ উঁচু হয়। দোতলা বাড়িতে বারান্দা থাকে। হুগলির দিকে ও ঘাটালের দিকে দোতলা বাড়ি একটু আলাদা হয়।
আগের দিনে ঘরে মাটির পাঁচিলের ভিতর টাসা দেওয়া হোত। এটা বর্তমান সময়ে পিলার ও লিন্টনের মতো কাজ করত।
এই কুঁড়ে ঘর গুলোই গরীব মানুষের স্বর্গ। কনকনে শীত ও দাবদাহ গ্রীষ্মের সুখের আশ্রয় । কাল বৈশাখী ঝড়ে চাল ওড়ে যাওয়ার একটা ভয় তো থাকেই। খড়ের চালের বাড়িতে গ্রীষ্ম কালে অনেক সময় অসাবধানে আগুন লেগে যায়। আগুন লেগে গেলে গৃহস্থ সর্বস্বান্ত হয়ে যায়।
অনেকে মাটির ঘরে উপর কোঠা না করে শুধু বাঁশ বেঁধে কাঠামো করে রাখে যাকে আড়াচ বলে। আড়াচে অনেক সময় খড়ের বোঝা (পুয়াল উছা), গমের খড় চাপানো থাকে। রান্না ঘরের আড়াচে ঘরের বিশেষ সময়ের জন্য খাঁচি, পেছ্যা, টুকি ডালা রাখা হয়। আর রান্না ঘরের আড়াচ থেকে শিকে ঝুলিয়ে রেখে খাবার যেমন দই, দুধ তুলে রাখা হয়।
ওপর কোঠায় ধান শুকনো বা মুড়ির ধানে চিট খাওয়ানো হয়। এছাড়া বাগানের তরমুজ জাতীয় চেলা বা খেড়া , কুমড়ো, পেঁয়াজ, পলাশ পাতার পতরির বোঝা, দনা, তুলে রাখা হয়। আড়াচ উঠতে বাঁশের বাঁকি বা সিঁড়ি লাগে অন্য দিকে উপর কোঠায় উঠতে লম্বা লম্বা কাঠের পাটার ওপর মাটির ধাপ তৈরি করে সুন্দর সিঁড়ি বানানো হয়। ওপর কোঠা থেকে সিঁড়ি রাঙামাটি, ছুঁত মাটি লেপে গোবর বুলিয়ে চিকন ও পরিষ্কার করা হয়।
আগের দিনে বিয়ে বা শ্রাদ্ধ বাড়িতে ওপর কোঠায় আত্মীয় স্বজনকে বসিয়ে খাওয়ানো হত। রাত্রে শোয়ার জায়গা করা হত।
কোঠা বাড়ির একটা বিশেষত্ব ছিল মগরার দুয়ার। ইউ আকৃতির বড় নীচু দুয়ারকে মগরার দুয়ার বলা হোত। মগরারার দুয়ার বলার কারণ আমার জানা নেই। তবে আমার মনে হয় মাটির কোঠাবাড়ির ড্রয়িং রুমে ঢোকার সদর দরজা হল মগরার দুয়ার।
মাটির বাড়ির চারপাশে মোটা ধারি করে রাখার চল আছে । এতে ঘরের দেয়ালে একটা বাড়তি সাপোর্ট পাওয়া যায় আর অবসর সময়ে বসতে কাজে লাগে। বেকার ছেলেদের ধারিতে আড্ডা মারলে বলে ” ধারি ভাপাচ্ছে “। ধারির নীচে আবার গোজ বা মেক লাগানো থাকে। ওতে সকালে বা বিকালে ঘরের গরু, ছাগল, বা গবাদি পশু বেঁধে রাখা হয়।
পরিত্যক্ত বাড়ির দেওয়ালে যেমন ঘুঁটে দেওয়া হয় তেমনি ভালো বাড়ির দেওয়ালে দুর্গা বা কালি পূজোতে বাঁদনা পরবে দেওয়াল চিত্র এঁকে শোভা বাড়ানো হয়। তেমনি পূর্ব মেদিনীপুরে বা টিনের দেওয়াল করলে ব্ল্যাক জাপান বা আলকাতরার প্রলেপ কালো রঙ করা হয়। হুগলির দিকে দোতলা উঁচু বাড়ি গুলোর দেওয়াল বাঁচাতে টিন বা টালির বাড়তি ছাউনি দেওয়ালে দেওয়ালে করা হয়। টাকা পয়সার অভাবে পলিথিন আড় দিয়ে বর্ষার সময় রাখা হয়, এতে মাটি ধুয়ে যায় না। এদিকে দেওয়াল চিত্র আঁকার চল নেই।
অ্যাডবেস্টাসের চালের গর্তে বর্ষার সময় একটা করে কাঠি রাখা হয় যাতে কম বৃষ্টির জল দূরে গিয়ে পড়তে পারে।
ফসলের খেতে পাহারা বা খেত রাখা করার জন্য টেন্টের মতো বাঁশ ও খড়ের অস্থায়ী ঘর করা হয় এগুলোকে কুমহা বলা হয়। কমুহা দু ধরনের হয়। এক ধরনের চার ধার খোলা রাখা হয় গ্রীষ্ম কালে আর টেন্টের মতো এ আকৃতির তিন দিক খড় দিয়ে বন্ধ থাকে শীতকালে।কুমাহায় ঢুকে দরজা বন্ধ করতেও খড়ের আটি আড় দেওয়া হয়। কুম্হায় খুব শীতেও গরম থাকে।
মাটির দেওয়াল খড়ের চালের আড়াচ সহ গরু বেঁধে রাখার জায়গাকে গোয়াল ঘর বা গহ্যাল বলা হয়। আগে প্রতি সরাক পরিবারের একটা গোয়াল ঘর মাড়িয়ে ভিতরে যেতে হত। এই ধরনের রীতি ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। আর প্রতিবৎসর এক বিশেষ তিথিতে হাল পূজা, গহ্যাল পূজা করার রীতি ছিল।
আবার পূর্ব মেদিনীপুরে অবসর সময় কাটাতে মাঞার ব্যবহার আছে। মাঞ্চায় গরমে বাতাস খাওয়া, তাস খেলা ও ঘরের থেকে বাইরে শান্তিতে থাকার জন্য ভালো।
বন্যা প্রবণ জেলার মাটির কুঁড়ে ঘর বেশ উঁচু ঢিপির ওপর করা হয় যাতে বন্যার জল না ওঠে। অতিরিক্ত জল উঠলে সে বাড়িও ভেসে যায়।
আর শহরের বেঁচে থাকতে গরীব মানুষের আশ্রয় স্থল হল ঝুপড়ি। ঝুপড়ির ওপরে পুরাতন ফেলে দেওয়া সাইকেল টায়ার চাপা দিলে ঝড়ে কম উড়ে যায়।
বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল