শুধু শিশু নয়, বিবেকের শিশুরাও জেগে উঠবে

তৈমুর খান

কবি অনিমেষ মণ্ডলের ‘ছন্দে গাঁথা ছড়ার কথা'(কলকাতা বইমেলা ২০২৩) কাব্যগ্রন্থটি ৫০টি ছড়া নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। স্বরবৃত্ত ছন্দের কাঠামোকে অনুসরণ করেই কবি এই ছড়াগুলি লিখেছেন। লোকসাহিত্যের সব থেকে প্রাচীন ধারা এই ছড়া। প্রায় প্রত্যেক কবিকেই ছন্দ ও ছড়ার মধ্য দিয়েই সাহিত্য জগতে পা রাখতে হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে ছড়ার গৌরব ও সুখ্যাতি কতখানি তা প্রায় সকল পাঠকই জানেন। ছড়া না জানলে কবিতা লেখাও অসম্ভব বলে আমি মনে করি। সুতরাং শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, সুকুমার রায় থেকে অন্নদাশঙ্কর রায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী,শক্তি চট্টোপাধ্যায়,শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী এবং সাম্প্রতিক কালের প্রায় সিংহভাগ কবিকেই ছড়া লিখতে দেখা গেছে।সেই ঐতিহ্যকে বহন করেই তরুণ কবি অনিমেষ এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন।
শিশুমনের জানা-অজানা কল্পনা ও অনুভূতিকে ছন্দের দোলায় দুলিয়ে দেওয়াই ছড়ার কাজ। শব্দ ও ধ্বনির সামঞ্জস্যে এক সুমধুর সুর-ঝংকার সৃষ্টি করলেই শিশুমন তা ধিনা ধেই ধেই করে নেচে ওঠে। বিষয় থাকলে হবে, না থাকলেও হবে। শুধু এক বাজনা ও গতি ছড়ার ক্ষেত্রে দরকার হয়। মাত্রা গণনায় ত্রুটি না থাকলে, পর্বগুলি সঠিকভাবে বিন্যস্ত হলে ধ্বনি ও লয়ের অভিক্ষেপ আপনিই হৃদয়কে নাড়া দিবে। যদি বিষয় থাকে,তাহলে শিশুমনে তা কখনো কখনো দাগ কাটতেও পারে। শিক্ষার ক্ষেত্রে,বুদ্ধিদীপ্ত পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে, কল্পনা শক্তিকে বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে এবং শব্দ সচেতন করে তুলতে ছড়ার মতো আর জুড়ি নেই। তাই লেখক কবিদের সাহিত্যের প্রথম সোপানে ছড়ার মধ্য দিয়েই অগ্রসর হতে হয়।শিক্ষার ক্ষেত্রেও অভিষেক হয় প্রথম ছড়ার মধ্য দিয়েই। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, ছড়া শুধু শিশু মন নয়, প্রতিটি বড় মানুষের মধ্যেও গোপন শিশুকে আকৃষ্ট করে থাকে। আর সেই কারণেই সাহিত্যের অন্যান্য শাখার থেকে ছড়ার পাঠক বেশি হয়। অনিমেষ হয়তো এসব কথা ভেবেছিলেন বলেই ছড়ালেখার প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করেছিলেন।
অনিমেষ কাব্যটিতে বহু রকম ছড়া লিখেছেন,বিষয়বৈচিত্র্যে নানা অভিজ্ঞতাকে তিনি ছড়ায় বন্দি করেছেন। বিশেষ করে গ্রাম্য প্রকৃতি,আকাশ-নিসর্গ, নানা ঋতু ও উৎসব, মানুষের জীবনযাত্রা, শিশুমনের বোধ ও কল্পনা, সুখ-দুঃখ, লকডাউন, প্রচলিত কিংবদন্তির নানা কাহিনি ও উপকাহিনি,এমনকি মোবাইলে সেলফি তোলার বিষয়টিও তাঁর চোখ এড়ায়নি। দুষ্টু ছেলের,ভালো ছেলের কথাও কোনো কোনো ছাড়ায় বলে দিয়েছেন। সুতরাং ছড়াগুলি পড়তে পড়তে আমাদের চোখে দেখা বিষয় তথা দৃশ্য এবং মনের আয়নায় ভেসে ওঠা অভিজ্ঞতার নানা স্তরগুলি খুব সহজেই বেজে ওঠে। ছড়াগুলিতে তা কখনো উচিত কথা হয়ে যায়। কখনো কাল্পনিক হয়েও বাস্তবের মতো সত্যে পরিণত হয়। যেমন অনিমেষ ঐতিহাসিক একটি দেশভাগের মতো বিতর্কিত বিষয়কেও যখন ছড়ায় লিখেন,তখন মানুষের মনের কথাই বলে দেন। মানুষ যে দেশভাগ চায়নি, হিন্দু মুসলিম বিভেদ,দাঙ্গা-রক্তপাত চায়নি তা ছড়ার অপূর্ব কথনে তিনি উল্লেখ করেছেন:
“এখনও তো ধর্ম খেলা
কোন জাতের?প্রশ্ন তোলা
দাঙ্গাবাজের উষ্ণশ্বাসে
দেশগাঁয়েতে ঘনায় আঁধার
হিঁদুর সাথে আমারও পণ
চু-কিত্-কিত্ খেলার সাথি
পায়ে পায়ে গর্জে উঠি
আমার গ্রাম,আমার দেশটি
রক্ত দিয়ে আগলে রাখি।”
রক্ত দিয়ে দেশ আগলে রাখা হিন্দু-মুসলিম উভয়েরই;একই আকাশ,একই বাতাস তাই তাদের কাছে ‘সীমানাটা বড্ড মিছে।’
অনিমেষ যুদ্ধ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন যা আজকের পরিণত প্রতিটি শিশু মনেরই উপযোগী। কিসের যুদ্ধ? কেন যুদ্ধ? এখন কোন যুদ্ধের সময়? এসব প্রশ্ন সকলেরই। তাই শিশুমনে প্রকৃত যুদ্ধের বিষয়টাকে তুলে ধরে বলেছেন:
“দেশজুড়ে আজ ভীষণ অসুখ
কাজ হারিয়ে, ঘর হারিয়ে,
দিশেহারা দেশের মানুষ
লড়ছে লড়াই হন্যে হয়ে।
লড়ছে যারা খেত-খামারে
যুদ্ধটা হোক তাদের লাগি,
অনাহারির শূন্য উদর
বুভুক্ষুদের ভাতের লাগি।”
সুতরাং বেঁচে থাকার লড়াই, সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনার লড়াই,মানুষের লড়াই,মানুষের মর্যাদার লড়াই এটাই তো প্রকৃত যুদ্ধ! কবি বুঝিয়ে দিয়েছেন এইসব ছড়ার মধ্য দিয়ে।
তেমনি আরও কিছু ছাড়ায় বৃক্ষরোপণের গুরুত্বও ফুটে উঠেছে। গাছ না থাকলে পৃথিবী বাঁচবে না,মানব সভ্যতাও থাকবে না এই চিরসত্য তত্ত্ব কথাটিও ছান্দসিক কবির ছন্দে তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে:
“ছেলেরা যে দল বেঁধেছে
এই পৃথিবী সবুজ হবে,
গাছের চারা আগলে রেখে
ওদের মত সতেজ হবে।”
গাছের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত করা এবং নিজেদের সঙ্গে গাছের তুলনা করা কবি শিক্ষা দিতে চাইলেন। ঋতুর ছড়া লিখতে গিয়েও গাছের কথা এল। প্রকৃতির নানা রূপের সঙ্গে কোন ঋতুর কী ফুল ফোটে সেই প্রসঙ্গও এল।
যেমন বর্ষাকালের জুঁই-টগর ফুলের সঙ্গে ইলিশ-মাগুর-কই মাছের কথাও। পোকামাকড় সাপের ভয়ও কবি জানিয়ে দিলেন। শ্রাবণ ধারার কথা লিখতে গিয়েও বাইশে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবসকেও বিষাদ মেঘের সঙ্গে তুলনীয় করলেন। লকডাউন এর সময়কালে কচিকাঁচাদের পড়াশোনা কিভাবে হবে তারও দিশা দেখালেন। ‘লকডাউনের ম্যাম’ সব মুশকিল আসান করে দিলেন। পশু-পাখির প্রতি ভালবাসাও ছড়াগুলিতে ফুটে উঠল। ‘দুঃখের পরি’-কে কিভাবে আদর করতে হবে সেই ভাষাও তিনি শিখিয়ে দিলেন। ক্ষুধার জ্বালা উপেক্ষা করার এবং দুঃখের পরে সুখ আসার কাহিনিও তিনি শোনালেন। পরাণ মাঝির মেয়ের ভাবনাতেও পাঠককে অন্তর্ভুক্ত করলেন। ফুটপাতের জীবন, শস্যহীন চাষির গোলা, ধর্ষিতার ছিন্ন শরীর সবকিছুই এই সময়ের কাব্য হয়ে উঠল। সমগ্র কাব্যেই এক বিস্তৃত অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে আছে । জীবনকে দেখার,জীবনের উত্তাপ স্পর্শ করার এবং স্বপ্ন বুননের গভীর তাৎপর্য ও পরামর্শ কবি পরোক্ষে দান করলেন। আর এখানেই অনিমেষ মণ্ডলের অনন্যতা। শুধু শিশুদেরই নয়, প্রতিটি মানুষের বিবেকের শিশুদেরও কবি সচেতন করে তুললেন।

ছন্দে গাঁথা ছড়ার কথা অনিমেষ মণ্ডল, অক্ষর সংলাপ প্রকাশন, ৮০৭, এস এইচ কে বি সরণি, কলকাতা ৭০০০৭৪, প্রচ্ছদ সন্ত কর্মকার, মূল্য ১৫০ টাকা।

