কুয়াশার ধোঁয়াশা
।। সুব্রত দত্ত ।।
ঠিক যেন স্বর্গ! যতদূর চোখ যায়, শুধু পাহাড় আর পাহাড়। নানা রঙ, নানা আকৃতি। কাছের পাহাড়গুলো গাঢ় সবুজ, তারপর ধীরে ধীরে দূরের পাহাড়ের রঙ ক্রমাগত নীল হয়ে আকাশের সাথে মিশে গিয়েছে। এখানে এক হোম স্টে-তে উঠেছে নীল আর শুভ্রা। দিন পনের হলো বিয়ে হয়েছে। নীলের প্রাইভেট কোম্পানিতে বেশি দিনের ছুটি পাওয়া যায় নি। তাই বড়দিনের ছুটি কাজে লাগিয়ে কাছাকাছি কলকাতা থেকে দার্জিলিং মেইলে শিলিগুড়ি, তারপর সেখান থেকে ছোট গাড়িতে করে কালিম্পঙ,
আলগারা হয়ে ‘এক টুকরো স্বর্গ’ পেডং! প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ওরা দু’জনেই মোহিত। হানিমুনটা খারাপ হবে বলে মনে হলো না। পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেছে।
স্নান সেরে হোম স্টে-র কেয়ারটেকার পর্তিমান রাই-এর ব্যবস্থাপনায় ভাত, ডাল, আলুর চোখা, ডিমের কারি, স্যালাড সহকারে অমৃতসম লাঞ্চ! আঃ! মনে থাকবে চিরদিন। নীল বলে,
— “কি গো, কেমন লাগছে?”
— “দারুণ! এত কাছে এমন একটা স্বর্গ আছে, না এলে জানতেই পারতাম না!”
নীল মনে মনে খুশি হয়। সেদিন দূরে কোথাও গেলো না ওরা। একটু রেস্ট নিয়ে, পায়ে হেঁটে চারপাশটা ঘুরে বেড়ালো। পুরো অঞ্চলটাই চড়াই উৎরাই। কত রঙ বেরঙের ফুল ফুটে রয়েছে অতিথিদের আবাহন করার জন্য! পাতাবাহার, আর আগে কখনো না দেখা অর্কিডের সমাহার! সরল পাহাড়ি মানুষগুলোর ব্যবহারও চমৎকার। সব মিলিয়ে প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হতে হয় বই কি! সূর্য ডুবলে ঠান্ডাটা আরো জাঁকিয়ে বসে। কথা বলতে গিয়ে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। তাই দেখে নীল বলে শুভ্রাকে,
— “এই, তুমি কি করছো?”
— “কেন, আমি আবার কি করলাম?”
— “কি আশ্চর্য! তুমি সিগারেট কবে ধরলে?”
— “কি? আমি আর সিগারেট!”
— “হুঁ, তোমার মুখ দিয়ে কেমন ধোঁয়া বেরোচ্ছে দেখো।”
— “ধ্যাৎ, তুমি না!”
শুভ্রা নীলের বাঁ হাতটা দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
— “বেশ করেছি। তুমি তো চেইন স্মোকার!”
নীল হেসে বলে,
— “কি করবো ম্যাডাম, এরকম চাকরিতে মাথা ঠিক রাখতে হলে, ওসব খেতে হয়।”
— “হুঁ, খেতে হয় না ছাই। ওসব তোমার লেম এক্সকিউজ।”
হোম স্টে-তে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ওরা ব্যালকনিতে বসে। রাই ওদের জন্য কফি আর স্ন্যাক্স দিয়ে যায়।
দূরের পাহাড়ের কোলে জন বসতিতে আলো জ্বলে উঠেছে। রাই বলে, ওগুলো নাকি সিকিম মনিপাল ইউনিভার্সিটির আলো। হোম স্টে-র তিন দিকে গভীর খাঁদ। ওরা দু’জনে যেন পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো গ্রহে রাত্রি যাপন করছে। কুয়াশার চাদর ভেদ করে চাঁদের আলো একটা নৈসর্গিক আবহ তৈরি করেছে।
শুভ্রা তো রীতিমত রোমাঞ্চিত! ওরা পাশাপাশি দাঁড়ায়। নিঃশব্দে কুয়াশায় মোড়া জ্যোৎস্না রাতের সৌন্দর্যকে ওরা যেন নিংড়ে নিয়ে আকন্ঠ পান করছে। নীল হঠাৎ শুভ্রাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— “আচ্ছা, বলো তো, তোমাকে কেউ এভাবে জড়িয়ে ধরেছে?”
— “কেন, তোমাকে কেউ ধরেছিল?”
— “তোমার সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে প্রেম করেছি। আগেই বলেছি। আমার জীবনে তোমার আগে তিনজন এসেছিল। কিন্তু কেউই বেশিদিন টেকে নি। ঠিক মনের মিল হয় নি। তাই প্রেমটা মাখো মাখো হয়ে ওঠে নি। তুমি কিন্তু তোমার এই বিষয় নিয়ে কোনদিন কিছু বলো নি। এড়িয়ে গিয়েছো। আজ বলো না। হ্যাঁ আগে যে কেউ আসতেই পারে। আমার যেমন এসেছিলো।”
— “না, এমন করে আমাকে ধরার সুযোগ কাউকে দিই নি। হ্যাঁ, একজন হিরোগিরি দেখিয়ে মন ভোলানোর চেষ্টা করেছিল। আমি ধরে ফেলেছিলাম। তাই আর এগোই নি।”
— “ইস বেচারি!
— “না, বেচারি নয় মোটেই। হুমকি দিয়েছিল। অন্য কাউকে বিয়ে করলে দেখে নেবে।”
— “এতবড় সাহস! তোমাদের পাড়ার ছেলে?”
— “হ্যাঁ, কেন?”
— “একদিন দেখিয়ে দিয়ো তো! খুন করে ফেলবো শালাকে।”
— “থাক, ওদের সঙ্গে লাগতে যেও না। বাজে ছেলে সব।”
— “না না, আমি ছাড়বো না।”
— “ওঃ, ছাড়ো না। ওসব কথা বলতে এখানে এসেছি নাকি?”
— “ওঃ, তাও বটে। হুঁ, তাহলে চুক করে একটা দেবে নাকি। তাহলে মনটা ভরে উঠবে।”
— “তুমি না যাচ্ছেতাই। রাই চলে আসতে পারে যে কোনো সময়!”
বলে শুভ্রা বড় বড় চোখে তাকায়। নীল বলে,
— “আচ্ছা আচ্ছা, তাহলে রাতে?”
—“হ্যাঁ, তাই।”
— “এমন সুন্দর সময়ে মনটাকে খারাপ করে দিলে। সেটাকে ভালো করতে একটা সুন্দর গান হয়ে যাক।
নাও, শুরু করো।”
— “এখন গান?”
— “হ্যাঁ, এখনই তো! পাঁচ বছরের প্রেমকালে কম গান তো শুনি নি তোমার। কিন্তু আজ এই বিশেষ দিনে, sorry রাতে, তোমার গান শুনতে যে মন চাইছে?”
— “ঠিক আছে করবো। তবে, আগে তুমি করো।”
— “না, তুমি।”
— “উঁহু, তুমি।”
— “ওহঃ, ‘সপ্তপদী’-র মত তুমি তুমি করেই রাত শেষ করে দেবে? প্লিজ, শুরু করো।”
— “ঠিক আছে। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম! রবীন্দ্র সঙ্গীত?”
— “হ্যাঁ, আজকের দিনের জন্য বিশেষ গান। এরপর যদি আর শোনার সুযোগ না পাই!”
— “কি সব বাজে কথা বলছো। তাহলে কিন্তু গান করবো না।”
ভালোবাসার মানুষের মুখে এমন কথা শুনে বুকে এক কষ্ট অনুভূত হয় শুভ্রার। দু’চোখের কোণে জল চিকচিক করে। নীল তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— “Sorry sorry! আর কক্ষনো বলবো না। আরে আজ তাড়াতাড়ি ঘুমোতে হবে। আঁধার রাতে উঠে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে যেতে হবে তো। নাও, গান শুরু করো।”
শুভ্রা গান শুরু করে।
“নব নব পল্লবরাজি
সব বন উপবনে উঠে বিকশিয়া,
দক্ষিণ পবনে সঙ্গীত উঠে বাজি।
মধুর সুগন্ধে আকুল ভুবন, হাহা করিছে মম জীবন।
এসো এসো সাধনধন, মম মন করো পূর্ণ আজি।।”
খুশিতে নীল লাফিয়ে ওঠে। বলে,
— “দারুণ, দারুণ! এমন নির্জনে তোমার এই গান, এই কন্ঠস্বর একটা আলাদা মাত্রা তৈরি করেছে। শুভ্রা, তোমায় পেয়ে আমি সত্যিই উচ্ছসিত।”
— “এই যে মশাই, এবার আপনার পালা।”
— “ধুস, এই গানের পর আর অন্যকিছু চলে নাকি?”
— “ও, খুব চালাকি, তাই না?” বলেই শুভ্রা নীলের পিঠে দুম দুম করে আদরের ঘুষি মারতে থাকে।
নীল শুভ্রাকে কোমড় জড়িয়ে তুলে নিয়ে খুশিতে ঘুরতে থাকে। শুভ্রা আঁতকে উঠে বলে,
— “এই, এই, পরে যাবো যে!”
— “হাঃ হাঃ হাঃ!”
হাসতে হাসতেই নীল শুভ্রাকে নীচে নামিয়ে দাঁড় করায়। তারপর অনেকটা সময় দু’জনে একাত্ম হয়ে জড়িয়ে থাকে।
ওরা তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে নেয়। শুভ্রা কাচের জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। বাইরের আলো আঁধারীর রহস্যে মোড়া পাহাড়গুলো যেন স্বর্গীয় আবেগ সঞ্চার করে। বিছানায় শুয়ে খুনসুটি চলে কিছুক্ষণ। তারপর দুই মানব মানবী আদিম খেলায় মেতে ওঠে। কাচের জানালার বাইরে কাছে-দূরের পাহাড়ে ওক, পাইন, বার্চ ও দেবদারু গাছেরা আলো আঁধারীর এক মোহময় জগৎ সৃষ্টি করে তাদের এই খেলার সাক্ষী হয়ে থাকে।
পরদিন ভোরে ওদের গন্তব্য ক্রস হিল পয়েন্ট। গরম কফি কোনক্রমে গলায় ঢেলে ওরা পৌঁছে যায় ক্রস হিল পয়েন্টে। ওপারেই তিব্বত। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাব্রু আর পাণ্ডিম শৃঙ্গের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য মনকে মাতিয়ে দেয়। আর রয়েছে গির্জা। রংপো নদী আর ঢেউ খেলানো চা-বাগানের অপরূপ শোভা পেডং-এর সম্পদ। কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যের আলো পড়তেই, তা ঠিকরে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। মনে হয় যেন হীরার লকেট প্রকৃতি দেবীর গলায় ঝুলছে। বেশ কিছু সময় ওরা অভিভূত চোখে চেয়ে থাকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রেশ মেখে ওরা ফিরে আসে হোম স্টে-তে।
সুস্বাদু মোমো দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নেয়। স্নান করে নীল আর শুভ্রা আবার বেরিয়ে পড়ে। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি সাংচেন দোর্জি গুম্ফা (মঠ)। তার দেয়ালে রয়েছে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের চিত্রাঙ্কন। অপূর্ব সেই দেয়াল চিত্র। সেখান থেকে ফেরার পথে সাক্যং, কাস্যং, কাগেই, মেঞ্চু — এসব পাহাড়ি গ্রাম ঘুরে ঘুরে ওরা ফিরে এলো। পথে রডোডেনড্রনের বিছানো চাদর দিগন্তে বিলীন। লাঞ্চ সেরে বিছানায় গড়িয়ে নেয় ওরা। নীল জিজ্ঞেস করে,
— “তুমি কি খুব টায়ার্ড?”
— “না, তেমন নয়। তবে একটু তো লাগছেই।”
— “সর্বনাশ!”
— “কেন, কি হলো আবার?”
— “আর মাত্র দুটো সিগারেট আছে। সারা রাত চলবে কি করে?”
— “থাক না, দুটো দিয়েই চালিয়ে দাও।”
ওদিকে আকাশ কালো মেঘে আঁধার নামিয়ে দিয়েছে। যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে মনে হয়। নীল বলে,
— “ইস, একদম খেয়াল করি নি। সেই বাজারে যেতে হবে। উম, তাহলে তুমি বরং রেস্ট নাও। আমি জাস্ট সিগারেট নিয়েই ফিরে আসবো।”
— “যাও, আমার থেকে সিগারেটই তোমার বেশি প্রিয়।”
— “প্লিজ, রাগ করো না। কালই তো আমরা কলকাতায় ফিরে যাবো। তারপর আবার সেই একঘেয়ে জীবন। আজ একটু ভালো করে মস্তি করে নিই। ঠিক আছে?”
— “আমি আর কি বলবো!”
শুভ্রা জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। নীল বেরিয়ে যায়। একটু পরেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়। বাজারে পৌঁছনোর আগেই নীল একটা হোম স্টে-র সামনের দোকানে আটকে পড়ে। তাকে দেখে এক যুবক এগিয়ে আসে। চেহারায় রাফ এন্ড টাফ। চুল দুদিকে পুরো ছাঁটা। মাঝের চুলগুলো বড় বড় তাতে আবার ময়ূরের মত রঙ করা। কপালে ‘শাহেনশা’-র মত সেই চুল ঝুলছে। এরকম উদ্ভট সাজের ছেলেদের নীল মোটেই পছন্দ করে না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যুবকটি বলে,
— “কি দাদা, কোত্থেকে?”
— “কলকাতা। আপনি?”
— “আমিও। আপনি কি হানিমুনে?”
— “হ্যাঁ, সেরকমই। ছুটি পাই নি। তাই এখানে।”
— “না, ভালো করছেন। এই জায়গাটা বেশ রোমান্টিক!”
— “হ্যাঁ, তা বটে। তো, আপনিও কি হানিমুনে?
— “না না, সেই সৌভাগ্য আর হলো কই? আপনি লাকী।”
— “কেন? বিয়ে করেন নি? কারণ?”
— “সে অনেক ব্যাপার। ”
— “আপনার নাম?”
— “কৌশিক। আপনার?”
— “নীল। সিগারেট কিনতে এসে আটকে পড়লাম!”
— “ও তাই?”
এই বলে সে নীলের দিকে সিগারেট এগিয়ে দেয়। নীল সেটা নেবে কিনা ভাবতে থাকে। যুবকটি বলে,
— “কি এত ভাবছেন? নিন নিন। পরে না হয় আপনি খাওয়াবেন। শোধ করে দেবেন। কেউ কিছু নিলে, ফেরত দিয়ে দিতে হয়।”
নীল দ্বিধাগ্রস্থভাবে হাত বাড়িয়ে সিগারেট নেয়।যুবকটিই লাইটার জ্বালিয়ে নীলের সিগারেটটা ধরিয়ে দেয়। সেটাতে টান মেরে কথা হয় কিছুক্ষণ। তারপর নীল বলে,
— “নাঃ, ফিরে যাই। কেয়ারটেকারের নিশ্চয়ই ছাতা আছে। ধার নেবো কিছুক্ষণের জন্য। বাই।”
— “বাই, আসুন দেখা হবে। আমি আছি।”
সন্ধ্যে নেমেছে। তার ওপর অঝোরে বৃষ্টি! শীতটা আরো জাঁকিয়ে বসেছে। নীল কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে শুভ্রাকে বলে তার সিগারেটের কাহিনী। শুভ্রা বলে,
— “ভালোই হয়েছে। এবার নেশা ছাড়াই থাকো।”
— “আজ্ঞে না। তোমার ঐ চোখের নেশার সাথে ধূমপানের নেশা মিলে মিশে আলাদা মৌতাতের খোঁজ পেয়েছি এখানে এসে। একটু অপেক্ষা করো। রাইয়ের ছাতা নিয়ে যাবো।”
— “তুমি তবু এই বৃষ্টির মধ্যে যাবেই?”
— “ওঃ, আমি কি একেবারেই চলে যাচ্ছি নাকি? এই যাবো আর আসবো।”
— “উঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না। যা খুশি করো। আমার কথা তো শুনবে না।”
নীল হাঁক দিয়ে রাইকে ডাকে। রাই বলে,
— “জী সাব!”
— “একটা ছাতা দাও না। একটু বেরোব।”
— “এখুন বাইরে যাবেন সাব? আমি কিন্তু পহেলা দিনমেই ভূতের কথা বলেছিলাম। এই আন্ধারে যাবেন না সাব।”
— “ধুস, যতসব ভীতুর ডিম। আমি ভূত বিশ্বাস করি না। দাও, ছাতা দাও।”
নীল ছাতা নিয়ে বেরিয়ে যায়। রাই ভীত চোখে তাকিয়ে থাকে। বাইরে ঝড়ের শোঁ শোঁ শব্দ। সঙ্গে বৃষ্টির ধারা।
অনেকটা সময় কেটে যায়। নীলের ফেরার নাম নেই। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি ধরেছে। শুভ্রা দুশ্চিন্তায় ছটফট করতে থাকে। এত দেরি তো হওয়ার কথা নয়! মোবাইল ফোনটাও সাথে নিয়ে যায় নি। রাগ হয় মনে মনে। এভাবে টেনশনে ফেলার কোনও মানে হয়? কি যে নেশার টান। ওটা না পেলে যেন জীবনটাই অচল হয়ে যায়। নীলটা এমন বে-আক্কেলে? তাকে একলা ফেলে রেখে কোথায় কোন আড্ডায় জমে গেল কে জানে! শুভ্রা সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। রাইকে ডাকে শুভ্রা। বলে,
— “একটু দেখবে, সাহেব আশে পাশে আছে কিনা?”
— “মেমসাব, আপনাকে একা রেখে কিমন করে যাই?”
— “উঃ, কি করি বলো তো?”
— “হামি তো তখুন যেতে মানা করলাম। শুনলোই না।”
— “কারো কথা শোনে? নিজে যা মনে করবে, তাই করবে। ধ্যাৎ, ভাল্লাগে না।”
— “চিন্তা করবেন না। সাব ঠিক চলে আসবে।”
না, নীল আর ফেরে নি। সারারাত শুভ্রা কেঁদে ভাসিয়েছে। বিদেশ বিভুঁইয়ে এমন অসহায় অবস্থার সম্মুখীন হবে, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবে নি সে। শ্বশুর বাড়ি আর বাপের বাড়িতে ফোনে জানিয়েছে সব। দাদারা পরের রাতেই এসে পড়বে। সকালের আলো ফুটতেই কিছু মানুষ জড়ো হয়। পুলিশকে জানানো হয়েছে। কিন্তু তারাও নীলের কোনও হদিশ দিতে পারছে না। জলজ্যান্ত মানুষটা গেলো কোথায়, শুভ্রা ভেবে পায় না। অজানা আতঙ্কে দু’চোখের পাতা এক করতে পারে নি সে। পুলিশ বলছে, নীল ফিরলে যেন খবর দেয়া হয়। তারাও মাঝে মাঝে ফোনে খবর নিচ্ছে। অনেক খুঁজেও নীলের রহস্যময় অন্তর্ধানের কিনারা করতে পারছে না। কোনও অঘটন ঘটলেও লাশটা তো পাওয়া যেতো! চারদিক তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে। কিন্তু সফল হয় নি। কোনও চিহ্ন মেলে নি।
কলকাতা থেকে শুভ্রার দাদা শুভেন্দু, নীলের ভাই দেবু আর তাদের সাথে কলকাতার নামকরা প্রাইভেট ডিটেকটিভ ছন্দময় গুপ্ত ফ্লাইটে বাগডোগরায় নামে। তারপর ছোট গাড়ি নিয়ে কালিম্পঙ থানায় কথা বলে পেডং-এ পৌঁছয় রাত ন’টা নাগাদ।পেডং-এর এস আই এর সঙ্গে কথা বলে হোম স্টে-তে আসে। দাদাকে দেখে শুভ্রা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করে। দাদা তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু শুভ্রার কান্না যেন বাঁধ মানে না। দাদা বলে,
— “চুপ কর শুভ্রা, চুপ কর। ভয় নেই। আমরা এসেছি তো। সঙ্গে কাকে এনেছি, দেখ। সেই বিখ্যাত গোয়েন্দা ছন্দময় গুপ্ত। উনি ঠিক এই রহস্য উন্মোচন করবেন। দেখিস।”
সেই রাতটাও অনিশ্চয়তায় কাটে। পরদিন ভোরে উঠেই ছন্দময় বেরিয়ে পড়ে। এলাকার আনাচে কানাচে তীক্ষ্ণ নজরে খুঁজে বেড়ায় কোন সূত্র পাওয়া যায় কিনা! হঠাৎ খাঁদের কিনারায় সে দেখে চারটে সিগারেটের ফেলে দেওয়া ফিল্টার টিপ। বৃষ্টিতে ভিজে গেলেও সেগুলো বেশিদিনের পুরোন নয়, তা বুঝে নেয় সে। সেগুলোর মধ্যে একটা ফিল্টার উইলসের এবং বাকি তিনটেই উইলস ফ্লেক সিগারেটের শেষাংশ। তার চোখের কোণে যেন আশার আলো দেখা গেলো! ছন্দময় রুমালে তুলে নেয় সেগুলো। ঠিক পাশেই কিছুটা ঘাস যেন মাটি থেকে ছড়ে গিয়েছে। ভারী কিছুর ঘষা লেগে এমনটা হয়ে থাকে। চারদিকে এবং খাঁদে চোখ বুলিয়ে সে ফিরে আসে হোম স্টে-তে। নীলের ভাই দেবু উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করে,
— “কিছু বুঝলেন?”
— “আচ্ছা, আপনার দাদার কি নেশা-টেশা করার অভ্যেস আছে?”
— “হ্যাঁ, তবে শুধু সিগারেটের। চেইন স্মোকার!”
— “কোন ব্র্যান্ড?”
— “সাধারণত উইলস ফিল্টার।”
— “হুঁ”
— “কেন?”
— “না, তেমন কিছু নয়। তবে এই ইনফর্মেশনটা পরে কাজে লাগতে পারে।”
ছন্দময় এস আই-কে ফোন করে আসতে বলে। এস আই মিঃ থাপা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়েন। ছন্দময় বলে,
— “কোনো ক্লু পেলেন?”
— “না, সেরকম কিছু তো খুঁজে পেলাম না।”
— “আশ্চর্য! একটা জলজ্যান্ত মানুষ হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে গেলো আপনারই এলাকা থেকে, আর আপনি হাত গুঁটিয়ে বসে আছেন?”
— “না মানে, চেষ্টার তো কসুর করি নি।”
— “ধ্যাৎ মশাই, আপনাদের চেষ্টা কেমন তা জানা আছে। এই জন্যেই পুলিশের ওপর মানুষের ভরসা উঠে গেছে। চলুন তো ওদিকটায়।”
ছন্দময় মিঃ থাপাকে খাঁদের কিনারায় নিয়ে যায়।বলে,
— “এই খাঁদে নামানোর মত কাউকে পাওয়া যাবে?”
— “হ্যাঁ, খবর দিলে চলে আসবে।”
— “ঠিক আছে, খবর দিন। কিন্তু তার আগে একটা ড্রোন নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন। এটা পারবেন তো?”
— “কি যে বলেন। পারবো না কেন। কালিম্পঙ থানায় আছে। ঠিক আছে আমি আনিয়ে নিচ্ছি।”
— “আচ্ছা ঠিক আছে, সব এলে আমাকে একটু কল করবেন। ততক্ষণে আমি বাকি কাজটা সেরে নিই।”
— “ঠিক আছে ছন্দময়বাবু, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। সবকিছু সময়মত পেয়ে যাবেন।”
ছন্দময় হোম স্টে-তে ফিরে আসে। শুভ্রার চোখে মুখে এই দু’দিনে বয়ে যাওয়া ঝড়ের চিহ্ন স্পষ্ট। ছন্দময়ের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে বলে,
— “ওকে পাওয়া যাবে তো? বেঁচে আছে তো?” বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
— “আমাকে আর একটু সময় দিন। সব উত্তর পেয়ে যাবেন। আশা করি সঠিক পথেই এগোচ্ছি। আপনারা সবাই একটু বসুন তো। কয়েকটা কথা জেনে নিই।”
শুভ্রা, শুভেন্দু আর দেবু যে যার মত বসে পড়ে। সামনের সোফায় বসে ছন্দময়। বলে,
— “আচ্ছা শুভ্রাদেবী, আপনাদের এমন কোনো শত্রু আছে, যে বা যারা এমন ঘটনা ঘটাতে পারে?”
শুভ্রা চমকে উঠে বলে,
— “এমন ঘটনা মানে? কি হয়েছে ওর?”
— “না, এখনো সেরকম কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারি নি। জানতে পারলে আমার কাজ করতে সুবিধে হতো। এই আর কি।”
শুভেন্দু আর দেবু মাথা নেড়ে জানায়, এমন কেউ আছে বলে তাদের জানা নেই। ছন্দময় শুভ্রাকে জিজ্ঞেস করে,
— “শুভ্রাদেবী, খুব ভালোভাবে ভেবে বলুন তো?”
শুভ্রা মাথা নিচু করেই উত্তর দেয়,
— “না, সেরকম কাউকে তো মনে পড়ছে না।”
— “কারো সঙ্গে কোনরকম ঝগড়া? কিংবা কারো হুমকি?”
— “না, কে আর হুমকি দেবে। নীল একদম নির্ভেজাল মানুষ। কোনও ঝামেলায় জড়ায় নি কখনও।”
— “আপনাদের বিয়ে কি প্রেম করে, নাকি দুই বাড়ির মানুষ দেখেশুনে ঠিক করেছে?”
শুভ্রা দাদার দিকে সলজ্জ দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে বলে,
— “প্রেম করে।”
— “কতদিনের?”
— “বছর পাঁচেক!”
— “কিছু মনে করবেন না, প্রাসঙ্গিক মনে হলো, তাই ব্যক্তিগত প্রশ্নটা করছি। এর আগে কারো সঙ্গে প্রেমে জড়িয়েছিলেন?”
— “না তো! তবে একটা ছেলে অনেকদিন ধরে আমার পেছনে লেগেছিলো।”
— “আপনার তরফ থেকে কিছু?”
— “আমার একটু একটু ভালো লাগছিল। কারণ, একদিন কতগুলো বখাটে ছেলের হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছিলো। কিন্তু ঘটনাটা সাজানো ছিলো। আর সেটা আমি ধরে ফেলি। ওই ছেলেগুলো ওরই বন্ধু ছিলো। তাই আমি সরে এসেছিলাম। তবুও আমার পিছু ছাড়ছিলো না।”
— “হুঁ, তারপর?”
— “আমাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেও আমাকে জ্বালাতে এসেছিলো। সেদিন খুব বাজে ভাবে ওকে বললাম যে সে যেন আমাকে পাওয়ার আশা না করে। সামনেই আমাদের বিয়ে। ও তখন প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়ে –”
শুভ্রার চোখ দু’টো দপ করে জ্বলে ওঠে।
— “হ্যাঁ, বলুন বলুন, ক্ষেপে গিয়ে ?”
— “হুমকি! হ্যাঁ, হুমকি দিয়েছিলো।”
ছন্দময় নিজের থাইয়ে সজোরে এক চাটি মেরে বলে,
— “ইয়েস, এটাই তো আমার জানার ছিলো। হ্যাঁ, তারপর? সে কি বলেছিলো?”
— “বলেছিলো, অন্য কাউকে বিয়ে করলে দেখে নেবে। ঘর করতে দেবে না।”
ছন্দময় শুভ্রার কাছ থেকে ছেলেটির নাম ঠিকানা নিয়ে নেয়। এরমধ্যে মিঃ থাপার ফোন আসে। সব রেডি আছে জায়গা মত। ছন্দময় বেরিয়ে যায়। পেছন পেছন সবাই চলে আসে খাঁদের কিনারায়। আশেপাশের মানুষরাও ভিড় জমিয়েছে উৎসুক হয়ে।
ড্রোনে ছবি তোলা হচ্ছে ছন্দময়ের নির্দেশমত। গভীর খাঁদের ছবিও তুলতে বলা হয়েছে। ছবি তোলা শেষে থানায় নিয়ে গিয়ে ভিডিও দেখতে থাকে ছন্দময় সহ থানার অফিসাররা। কালিম্পিঙ থেকেও অফিসার এসেছেন। ভিডিও দেখতে দেখতে হঠাৎ ছন্দময় এক জায়গায় পজ করতে বলে। তারপর জুম করতে বলে। হ্যাঁ, এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, কোনও মানুষ উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। ছন্দময় চেঁচিয়ে বলে,
— “মিঃ থাপা, এই তো পাওয়া গেছে। আপনার শেরপাদের নামিয়ে দিন। ওকে তুলে আনুক।”
— “বেঁচে আছেন কি?”
— “আগে তুলুন, তারপরে দেখা যাবে সব।”
মোটা মোটা দড়ি বেয়ে ছ’জন মানুষ নামে খাঁদের গভীরে। ভিডিওতে দেখানো জায়গায় একটা মানুষকে পরে থাকতে দেখে ওরা। নাকের সামনে হাত রেখে বুঝতে চেষ্টা করে, লোকটি জীবিত নাকি মৃত!হ্যাঁ, শ্বাস পড়ছে তো! ওরা আনন্দে চেঁচিয়ে বলে,
— “শাস লে রহা হ্যায়। জিন্দা হ্যায়।”
কথাগুলো পাহাড় থেকে পাহাড়ে ধাক্কা লেগে অনুরণিত হয়ে সবার কানে পৌঁছে যায়। শুভ্রাদের প্রাণে জল আসে। শুভ্রার চোখে আনন্দাশ্রু! হাত জোড় করে ঈশ্বরকে স্মরণ করে। ছন্দময় কলকাতা পুলিশের সাথে ফোনে কিছু জরুরি কথা সেরে নেয়।
মিঃ থাপা এম্বুলেন্স রেডি করে রেখেছেন। ছ’জন শেরপা বহু কষ্ট করে নীলকে ওপরে তুলে আনে। শুভ্রা দৌড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ে তার বুকে। কান্নায় ভেঙে পড়ে সে বলে
— “নীল, কথা বলো, কথা বলো না নীল। এই তো আমি।”
সবাই তাকে সরিয়ে নেয়। কালিম্পিঙ হসপিটালে প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে, নিয়ে যাওয়া হয় শিলিগুড়ির একটি নার্সিং হোমে। নীলের বাঁ হাতটা ভেঙেছে। তাছাড়া শরীরের নানা জায়গার চোট সারাতে সময় লাগবে।
সেই রাতে ছন্দময় কলকাতায় ফিরতে পারলো না। নীলের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসায় ভালোই সারা দিচ্ছে। জ্ঞান ফিরেছে। আই সি ইউ -তে কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। শুধু ছন্দময় আর দু’জন পুলিশ অফিসার ছাড়া। নীল ধীরে ধীরে বলতে থাকে সেই বীভৎস রাতের অভিজ্ঞতার বর্ণনা! পরে ছাতা নিয়ে সিগারেট কিনতে যাওয়ার সময় কৌশিক আর ওর দুই বন্ধু কথা বলতে বলতে তাকে খাঁদের কিনারে নিয়ে আসে। নীল তার প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা ধরিয়েছিলো আর ওরা তিনজন নিজেদের সিগারেট।
কিছুক্ষণ কথা বলার পর হঠাৎ কৌশিক নীলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় খাঁদে। মোটা লতানে গাছ ধরে ঝুলতে থাকে নীল। কিন্তু ওই মুষলধারে বৃষ্টির জন্য বেশি সময় আঁকড়ে থাকতে পারে নি সে। আরো নীচে পড়ে যায় যখন, তখনই বাঁ হাতে ভীষণ ব্যথা অনুভব করে। তারপর আরো গড়াতে থাকে। তারপর আর কিছু মনে নেই তার। নীলের সুস্থ হয়ে কলকাতায় ফিরতে কিছুটা দেরি হবে। কিন্তু ছন্দময়কে পরের দিন ফিরতেই হবে। শুভ্রা এসে ছন্দময়কে বলে,
— “আপনি না এলে ওকে ফিরে পেতাম না। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।”
— “না না, ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই। এটাই তো আমার কাজ। তবে, কৌশিকের মত ছেলেদেরকে আপনার মত মেয়েদের কি করে ভালো লাগা শুরু হতে পারে, সেটা ঠিক আমার মগজে ঢোকে না।”
শুভ্রা মাথা নিচু করে বলে,
— “ওটা আমার সত্যিই ভুল ছিলো। তবে বুঝতে পেরে সরেও তো এসেছিলাম।”
— “হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক। ও হ্যাঁ, আপনাদের আরো একটা সুখবর দেবো।”
— “সুখবর?”
— “হ্যাঁ, সুখবর! কলকাতায় ওদের তিনজনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। ওরা স্বীকারও করেছে।”
— “সত্যিই খুব ভালো খবর। চরম শাস্তি যেন পায়।”
— “সেটা অনেকটাই নির্ভর করছে কোর্টে আপনার স্টেটমেন্টের ওপর। আপনার যদি ওদের দেখে মায়া হয় আর নরম স্টেটমেন্ট দেন, তাহলে ছাড়া পেয়ে যাবে।”
শুভ্রার চোখদু’টো জ্বলে ওঠে। বলে,
— “কক্ষনো নয়। আমি ওদের ফাঁসি চাই।”
— “ঠিক আছে। আমি তাহলে বিদায় নিচ্ছি সবার কাছ থেকে। বাই!”
— “আবার আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। বাই!”
একটা শান্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুভ্রা আনমনে চেয়ে থাকে ছন্দময়ের যাওয়ার পথে।
SUBRATA DUTTA