You are currently viewing কে সে জন

কে সে জন

কে সেই জন

আমরা তিনজনই সিটি কলেজের ছাত্র ছিলাম। তিনজনই খুব ভালো বন্ধূ ছিলাম, আমি, গিয়াস এবং রিমি। কলাবাগানে একটি টিনসেড বাড়ির একটি রুম ভাড়া নিয়ে আমি আর গিয়াস থাকতাম। রিমি থাকত জিগাতলা মোড়ে ওর খালার বাসায়। ক্লাসে আরো ছেলেমেয়ে ছিল, তাদের সাথে বন্ধুত্ব হলো না, বন্ধু হলাম আমরা তিনজন, রিমি, গিয়াস আর আমি।

রিমি যেদিন ক্লাশে আসত না সেদিন খুব মন খারাপ লাগত। ক্লাশ করতেও মন চাইত না। এক দুই ক্লাশ করে চলে যেতাম বাসায়। শুয়ে থাকতাম বিছানায়। তারপর চোখে ঘুম আসত এবং ঘুমিয়ে যেতাম। যখন ঘূম ভাঙ্গত তখন দেখতাম সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গিয়াস ততোক্ষণে চলে আসত এবং বলত – ‘তুই কি রিমির জন্য মন খারাপ করে থাকিস ?’

আমি : হে।
গিয়াস : তুই কি রিমিকে ভালোবাসিস ?
আমি : না।
গিয়াস : দুপুরে কিছু খেয়েছিলি ?
আমি : না ।
গিয়াস : চল্ কালা চাঁদের হোটেলে যেয়ে কিছু খেয়ে আসি।
আমি : চল্।

সেদিন একাউন্টিং ক্লাশের স্যার আসেন নাই। আমরা তিনজনেই মিরপুর রোডের ‘চিরোকী’তে বসে আড্ডা দেই। আমাদের তিনজনের মধ্যে সেদিন অনেক কথাই হয়েছিল। অনেক গল্প করেছিলাম তিনজনে। না বলা অনেক কথাও হয়েছিল আমাদের মধ্যে। বলেছিলাম- কলেজে পড়া শেষ হলে কে কোথায় চলে যাব, কে কোথায় পড়ব ? কে কখন বিয়ে করব, আরো অনেক কথা। তিনজনে কথা বলতে বলতে কখন ক্লাশ আওয়ার ওভার হয়ে গিয়ছিল আমরা তা জানি নাই। সেদিন আর ক্লাস করা হয়নি।

বিকালে পড়ার টেবিলে বসে মার্কেটিংএর নোট খাতার ভিতর কি সব হিবিজিবি লিখছিলাম-

তুমি কি শুধুই বন্ধু হওয়ার জন্য এসেছিলে ! তুমি শুধু সহপাঠি নও আমার,
তুমি কাকে ভালোবাসো আমি জানিনা,
আমি পূর্ব মেঘে তাকিয়ে দেখেছি- সেখানে কেবল কালো মেঘ
আমি উত্তরের মেঘে তাকিয়ে দেখেছি- সেখানে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে,
আমি তোমাকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখতে চাইনা,
তবুও আমার দু’চোখ মুদে ঘুম আসে-
ঘুমেও নয়, স্বপ্নেও নয় হঠাৎই মনে হয় আমি তোমাকে
কাছে টেনে বলছি- ভালোবাসি।

ওপাশে তাকিয়ে দেখি গিয়াস ওর পড়ার টেবিলে বসে কি যেন লিখছে। আমি ওকে বলি- ‘কি লিখছিস ?’ গিয়াস বলে- ‘কবিতা লিখছি।’ আমি বলি- ‘তুই আবার কবি হলি কবে ?’ গিয়াস উত্তর দেয় – ‘এমনি হিবিজিবি কিছু লিখছিলাম।’ আমি বলি- ‘পড়ে শোনা।’ ও তখন আমাকে পড়ে শোনায়-

আমার থেকে হাজার ক্রোশ দূরে তুমি বসে আছো
শুনতে কি পাও ভালোবাসার মর্মরধ্বনি ?
লক্ষ যোজন দূরে থেকে বুঝতে কি পারো
আমার হৃৎ কম্পনের কথা ?
নির্জন নিরালায় তুমি আমার গান হয়ে ওঠো
শ্বেতকমলে তোমার পরশখানি জেগে ওঠে-
এখনো দূর হতে কোনো কোমল সিম্ফনি ভেসে আসে
এখনো তোমার জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকে।

আরেকদিন কলেজে গিয়ে হঠাৎ শুনতে পাই আজ কোনো ক্লাশ হবে না। কি যেন এক দাবীতে শহরের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হচ্ছে। মন খুব একটা খারাপ হলো না। বলাকা সিনেমা হলে চলছিলো ‘সূর্যকন্যা’। আমরা তিনজন টিকিট কেটে সাড়ে বারোটার শো’তে হলে ঢুকে পড়ি। সারা সিনেমা চলাকালীন সময়ে রিমি আমার এক হাত ধরে থেকেছিল। ওর আরেক হাত ধরেছিল গিয়াসের হাত। সিনেমা শেষে আমরা তিনজন নিউ মার্কেটের ভিতরে লিবার্টি খাবার হোটেলে যেয়ে ভাত খেতে বসি। রিমি গুণগুণ করে আস্তে আস্তে আমাদের কানের কাছে সুর্যকন্যার এই গানটি গাচ্ছিল–

‘আমি যে আধারে বন্দিনী আমারে আলোতে ডেকে নাও
স্বপন ছায়াতে চঞ্চলা আমারে পৃথিবীর কাছে নাও.
শ্রাবণ ঘন এই আকাশ কালো তৃষিত হৃদয় মোর জ্বেলেছে আলো
এবার আমায় বাসিবে ভাল প্রিয় তুমি কথা দাও কথা দাও।’

মাঝে মাঝে নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করি, রিমি কাকে ভালোবাসে ? আমাকে না গিয়াসকে ? না অন্য কাউকে ? তার কোনো হিসাব মিলাতে পারিনা। শুধু এইটুকুই জানি, আমি রিমিকে ভালোবাসি, তা কেউ জানে না।

দেখতে দেখতে কখন আমাদের সব সিলেবাস শেষ হয়ে গেল, দেখতে দেখতে আমাদের শেষ ক্লাশটিও হয়ে গেল। এবং একসময় ফাইনাল পরীক্ষাও হয়ে যায়। এই ভাবেই আমাদের কলেজ পাঠ পর্ব শেষ হয়ে যায়।

সেদিন চলছিল আমাদের কলেজে একে অপরের বিদায় নেবার পর্বের দিন। দেখলাম রিমি একটা নীল রঙ্গের শাড়ি পড়ে কলেজে এসেছে। এর আগে ও কখনো শাড়ি পড়ে কলেজে আসে নাই। আজকেই প্রথম, আজকেই শেষ শাড়ি পড়া। খুব ভালো লাগছিল ওকে নীল শাড়িতে। সহপাঠীদের সাথে অনেক সুখের কথা হলো, অনেক প্রাণের কথা হলো। অনেক স্মৃতিচারণ হলো। তারপর আমরা তিনজন হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই ধানমন্ডি লেকের ধারে।

লেকের পাড়ে সবুজ ঘাসের উপর তিনজন বসে আছি। লেকের জল তখন নীরব স্থির হয়ে আছে। ঝিরিঝিরি কোনো বাতাস নেই। জলের উপর ছোটো ছোটো কোনো ঢেউ নেই। কড়োই,জারুল, কৃষ্ণচূড়া গাছে দু’একটি পাখি করুণ সুরে ডাকছিল। বিকেলের সূর্য গাছের আড়ালে চলে গেছে। আলোছায়ায় অনেকটা মন খারাপ করেই আমরা বসে আছি। কে কি বলব, যেন আমাদের কোনো ভাষা নেই। তারপরেও বললাম রিমিকে- কবে বাড়ি যাচ্ছো ?

রিমি : কালকেই। তোমরা কবে যাচ্ছো ?
আমি : আগামী মাসের এক তারিখে। রুম ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ করেছি।
গিয়াস : একই তারিখে আমিও যাচ্ছি।
রিমি : তোমরা ভুলে যেওনা আমাকে।
আমি: তুমিও ভুলে যেওনা। চিঠি লিখবে।
গিয়াস: আমিও ভুলব না। চিঠি লিখো।

রিমি চলে গেছে ওর দেশের বাড়ি বাগেরহাট। আমি আর গিয়াস এক তারিখেই রুম ছেড়ে দিয়ে যার যার মতো দেশের বাড়ি চলে যাই। গিয়াস চলে যায় পটুয়াখালীতে, আর আমি চলে আসি সিরাজগঞ্জে।

বাড়িতে গিয়ে মনটা উড়ো উড়ো লাগছিল। কারো সাথে ঠিক মতো মন খুলে কথা বলতে পারছিলাম না। এমনিতেই একাকী যেয়ে নদীর কূলে বসে থাকতাম। নয়তো মাঠের আলপথ দিয়ে, ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে হাঁটতাম। মনের মধ্যে কি এক ভ্রান্তি ঢুকেছিল যে, তা কাউকে প্রকাশ করতে পারছিলাম না। নির্জন প্রান্তরের অশ্বথ গাছের তলে বসে ভাবতাম আর অনুশোচনা করতাম, আমি তো রিমিকে ভালোবেসেছিলাম। এই কথা কেনোদিন তাকে আমি বলি নাই। যে কথা বলি নাই তা নিয়ে এখন কেন অনুশোচনা করছি ?

সেদিন ছিল হাটবার। আমাদের ছোনগাছা হাটে সেদিন মেলাও ছিল। মেলায় উৎসবের আমেজ। বাঁশের বাঁশি বাজছে। চারদিকে ঢাকের শব্দ, কাঁসার শব্দ। নাগরদোলার চড়কি ঘুরছে। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে কালি সন্ধ্যা হয়েছে। আমি একপাশে দাঁড়িয়ে নাগরদোলার ঘূর্ণি দেখছিলাম। পোস্ট অফিসের পিয়ন আমাকে দেখে একটি চিঠি দেয়। প্রেরকের জায়গায় লেখা- রিমি, বাগেরহাট। আমি মেলার মধ্যে অন্ধকারে চিঠিটি আর খুললাম না।

রাতে বাড়িতে এসে হেরিকেনের আলোয় চিঠিটি খুলে পড়তে থাকি–

‘প্রিয় বন্ধু আমার,

তোমরা দু’জনই আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলে। তোমাদের দু’জনকেই আমি খুব ভালোবাসতাম। বাড়িতে এসে তোমাদের জন্য আমি অনেক কেঁদেছি। তুমি কি আমাকে ভালোবাসতে? কই, কখনো বলোনি তো – ‘তোমাকে ভালোবাসি।’ আমাকে যে বলেছে ‘ভালোবাসি’, তার সাথেই আমার বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের তারিখ : ১৪ ই ফাল্গুন, ১৩৯০ বাং । তোমাকে নিমন্ত্রণ দিলাম। চলে এসো।

ইতি- রিমি।’

বুঝতে পারলাম গিয়াসের সাথে রিমির বিয়ে হচ্ছে । অভিমানে আমি আর বিয়েতে যাইনি। তারপর আর কোনো যোগাযোগও রাখিনি।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নেই। এবং একটি সরকারি চাকুরীও পেয়ে যাই।

তারপর দশ বছর চলে গেছে। একবার একটি সরকারী কাজে গিয়েছিলাম- পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়। কাজের ফাঁকে একদিন কুয়াকাটা বীচে বেড়াতে যাই। সাগরপাড় এত জমজমাট তখন ছিল না । একদম বিরাণ বালুকাবেলা ছিল। তখন সূর্যাস্তের সময়। সাগর তীরে একাকী হাঁটছিলাম, আর সূর্যাস্ত অবলোকন করছিলাম– হঠাৎ ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির এক লোক আমার কাছে এগিয়ে আসে। চিনতে অসুবিধা হলো না। এ যে সেই গিয়াস !

কাছেই লতাচাপালী গ্রামে গিয়াস থাকে। ও এখানকার এক প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। আমাকে জোর করে ওর বাড়িতে নিয়ে যায়।

বাড়িতে আমি তখন খুঁজতে থাকি রিমিকে। কিন্তু কোথাও রিমিকে দেখতে পেলাম না। তখন গিয়াসকে জিজ্ঞাসা করি- ‘রিমি কোথায়?’ গিয়াস আমার কথা শুনে বিস্মিত হয়। এবং উল্টো আমাকে বলে – ‘তুই রিমিকে বিয়ে করিস নাই ? ‘ আমি বলি – ‘না।’

গিয়াস তখন ওর স্টীলের ট্রাংক খুলে রিমির একটা চিঠি বের করে আমাকে দেখায়– সেই একই চিঠি, একই ভাষা, এবং একই তারিখ, যা রিমি আমাকেও লিখেছিল ।

~ কোয়েল তালুকদার

inbound4547984463108749770.jpg

Koyel Talukder

Leave a Reply