রাতের ক্ষণিকা
ব্যবসায়িক কাজে সেইবার পর্যটন শহর কক্সবাজার গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে রাতের কোচে রওনা হই। আমাদের বাসটি কক্সবাজার বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে যখন পৌঁছে তখন বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে যায়।
বাস থেকে ব্যাগ নিয়ে নেমে পাশেই একটি ছোট্ট রেস্টুরেন্টে নাস্তা করতে ঢুকি। একটি মধ্য বয়স্ক লোক আমাকে অনুসরণ করছিল। সে বাইরে সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।
আমি চা নাস্তা খেয়ে সিগারেটের দোকানের সামনে এসে এক প্যাকেট সিগারেট কিনি। ও সিগারেট ধরাই। লোকটা তখন আমার পাশে এসে দাঁড়ায়।
লোকটি দেখতে বেশ ভদ্রই মনে হল। পরিচ্ছন্ন কাপড় চোপর পরা,পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো। পায়ে সুন্দর জুতা। সার্টের পকেটে চমৎকার একটি ফাউন্টেন কলম। সেই আগবাড়িয়ে আমাকে বলছিল-
— আপনি কী ঢাকা থেকে এসেছেন?
— জ্বী।
— হোটেল বুকিং করা আছে?
— না। খুঁজে নেব।
— আমাদের একটি কটেজ আছে। খুব সুন্দর। পাহাড়ের ঢালে। সাগর মুখো। মোটামুটি কম ভাড়া। আমরা অতিথিদের রান্না করে খাওয়াই। আপনি ইচ্ছে করলে আমাদের কটেজে উঠতে পারেন।
লোকটির বাচনভঙ্গি ছিল চমৎকার। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছিল। আমি ওনাকে বললাম — আপনাদের কটেজের নাম কী?
— ‘ক্ষণিকা’।
— খুব সুন্দর নাম। রবি ঠাকুরের ক্ষণিকা। তা, চলুন আপনার কটেজে। ‘ক্ষণিকা’তেই থাকব।
রিক্সায় করে পথে যেতে যেতে ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার নাম কী?
— মোহাম্মদ খোরশেদ আলম।
— আপনি এই কটেজের কী?
— আমি মালিক।
আমি একটু অবাক হলাম, মালিক নিজেই ব্যবসা ধরার জন্য বাসস্টান্ড পর্যন্ত চলে এসেছে।
উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল — কয়দিন থাকবেন?
আমি বললাম, ব্যবসায়িক কাজে এসেছি। তিন চার দিন থাকতে হতে পারে।
রিক্সাটি একসময় একটি পাহাড়ি টিলার কাছে এসে থামে।
টিলার সামান্য ঢাল বেয়ে একটু উপরে উঠতেই দেখতে পেলাম একটি কাঠের বাড়ি। ছোট্ট একটি সাইনবোর্ড লাগানো আছে। লেখা — ‘ক্ষণিকা’।
একদম ঘরোয়া বাড়ি। সবশুদ্ধ চার পাঁচটি অতিথি রুম আছে। সামনে বারান্দা। ওখান থেকে সাগর দেখা য়ায়। যদিও অনেক দূরে।
আমি বারান্দার কাছে রুমটা পছন্দ করি এবং ঐ রুমেই উঠে পড়ি। খুব সুন্দর পরিপাটি রুম। পরিচ্ছন্ন বিছানা পত্র। কাপড় রাখার ওয়ারড্রব, ড্রেসিং গ্লাস, সাইট টেবিল, দেয়ালে তৈলচিত্র, ওয়াল ঘড়ি, টেলিভিশন, খাবারের গ্লাস, কাগজ কলম, এ্যাসট্রে, মিলারেল পানি সহ সবই আছে।
আলম সাহেব কলিং বেল দেখিয়ে বললেন — আপনার যখন যা লাগবে, কলিং বেল বাজাবেন। আমি অথবা আমার কেয়ার টেকার চলে আসবে।
আলম সাহেবকে বললাম — আচ্ছা। তাই করব।
তাকে বললাম, আমি শুধু সকালের নাস্তা ও রাতের খাবার এখানে খাব। অফিসের কাজে যেহেতু বাইরে বাইরে থাকতে হবে, তাই দুপুরের খাবার আমি অন্য কোনো রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিব।
খোরশেদ আলম সাহেব বললেন — আচ্ছা।
সেদিনের বিকেলটুকু ব্যবসায়িক কাজ সেরে সন্ধ্যায় কটেজে চলে আসি। ডাইনিং রুমে বসে রাতের খাবার খেয়ে নেই। মেনু ছিল রূপচান্দা ও কোরাল মাছ। সাথে সালাদ ও ডাল ছিল। বেশ সুস্বাদু ছিল সবকিছু।
সবকিছুতেই ভদ্রলোকের রুচির ছাপ আছে। সাউন্ড বক্সে খুব কোমল সুরে মান্না দে’র গান বাজছিল। ‘দাঁড়িয়ে আমার চোখের আগে
রাঙ্গালে এ মন পুস্পরাগে
কে গো চম্পাবরণী।
কে তুমি তন্দ্রাহরণী।’
আমি একটি জিনিস খেয়াল করলাম, কটেজের অন্য রুমগুলো ছিল খালি। কোনো গেস্ট ছিল না। কেমন যেন সুনসান নীরব পরিবেশ, কেমন যেন আলোছায়াময় অন্ধকার সারা কটেজ জুড়ে!
রাতে রুমে শুয়ে আছি। নতুন জায়গা ঘুম আসছিল না চোখে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি, রাত একটা। খুব ইচ্ছা হল দূরের রাতের সাগর দেখবার। খুব মন চাইল, কান পেতে শুনতে সাগরের গর্জন।
দরজা খুলে চলে আসি বারান্দায়। দাঁড়িয়ে থাকি সমুদ্রের দিকে চেয়ে। দূরে সমুদ্র, কাছেই আকাশ। ও পাশটায় ঝাউবন। ঝাউঝাড়ে তখনও জোনাকি জ্বলছিল। আর দুরে থেকে ভেসে আসছে জলের শব্দ।
আকাশের দিকে চেয়ে দেখি, আকাশ ভরা তারা। কী স্বপ্নময় লাগছিল।
কবে কোন্ কবি আপন ভাবালুতায় লিখেছিল কবিতা।
যদি আজ রাতে সেই কবিতাখানি কেউ গানের সুরে গেয়ে শোনাত–
ঝাউবনের মাথার উপর
তবু জেগে রয় এক টুকরো মেঘের উচ্ছ্বাস!
রক্ত-চোখ খুনি কাঁকড়ারা আজ হাজার হাজার মাইল
সমুদ্র সৈকতে নিরব পাহাড়ায় ্
আমি আজ তোমাদের প্রাত্যহিকের নিয়ম ছেড়ে অনেক দূরে
এক কুয়াশাময় সম্পর্কহীন মাদকতায় অলস-কথা ভাষাহীন!
এখন রাত্রি নক্ষত্রের!
জানি তোমরা আজ মেলায় মাতোয়ারা
আমায় নির্জনতা ডাকে
আমি আজ সাগরে!
সাগরের দিক থেকে হিমেল বাতাস এসে লাগল গায়ে। তারারা এসে আমার চোখের পাতায় ছুঁয়ে দিল। কেমন যেন ঘুম পাচ্ছিল। ভাবলাম, যাই, শুয়ে পড়ি। পিছনে ঘুরতেই দেখি — বারান্দার আর এক পাশে একটি মেয়ে ঝাউ গাছের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। নীরবে নিঃশব্দে কখন এসে সে দাঁড়িয়েছিল, আমি বুঝতে পারিনি।
আমি ঐ মেয়ের সাথে কোনো কথা না বলে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়ি।
দ্বিতীয় রাত্রি–
সারাদিন অফিসের কাজে বেশ পরিশ্রান্ত ছিলাম। রাতে খেয়ে একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ি এবং ঘুমিয়ে যাই। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। শুয়েই আছি। কী যেন দেখার জন্য চিত্ত অস্থির হতে থাকে। সাগর নাকি ঝাউগাছ! নাকি তারাভরা আকাশ! নাকি কালকের সেই মেয়ে! কিসের এক টানে বাইরে বারান্দায় চলে যাই। দেখি কেউ নেই। সাগরের দিকে তাকাই —
জলের শব্দ আজ নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে। জোনাকিরা আজ জ্বলছেনা ঝাউবনে। তারারা অনুজ্জ্বল হয়ে আকাশে জ্বলছে!
পিছনে ঘুরে তাকাতেই– দেখি, কালকের সেই মেয়ে। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরিহিত। বয়স তেইশ চব্বিশ বছর হবে। চুল খোঁপা বাঁধা। বেলী ফুলের মালা দিয়ে জড়ানো। আলো আঁধারে মুখখানি দেখলাম– দোলনচাঁপার মতো স্নিগ্ধ, হাত দুটি যুঁথিবদ্ধ, চোখের তারায় য়েন জোনাকি জ্বলছে!
বললাম — তুমি কে?
— আমি লাবণী। আমি তোমাকে দেখেছি দূর থেকে। চুপিচুপি। তুমি তা জানো না। কী বিশ্বাস তোমার প্রতি হল। তুমি যেন আমার কত ভরসার!
— তাই!
— আমাকে দেখতে খুব অপূর্ব লাগছে! না!
— হুম! খুব ভালো লাগছে!
— আমাকে তুমি সাথে করে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে?
— তুমি কে? তোমাকে চিনি না। জানি না।
— আমি খুব দুঃখী মেয়ে। দাম নিয়ে ভালোবাসা আর কাউকে দিতে ইচ্ছা করে না। ভালোবাসা প্রাণে থেকে দিতে ইচ্ছা করে। আমি খুব কাঙাল। আমি যে বন্দিনী। আমাকে তুমি এখান থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাও।
— খোরশেদ আলম সাহেব তোমার কী হয়?
— সম্পর্কে উনি আমার মামা হন।
— দেখো, আমি এখানে পরদেশি। আমার খুব ভয় হচ্ছে।
তুমি রুমে চলে যাও। শুয়ে পড়ো। আমি তোমার কথা ভেবে দেখব।
তৃতীয় রাত্রি —
সারাদিন কাজের ভিতর ঘুরে ফিরে একটা কথাই কানে বাজছিল, ‘ আমাকে তুমি তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে?’ সে তো খুব রূপবতী মেয়ে! কেন এমন তার আকুতি? সন্ধ্যাবেলা কটেজে ফিরে বারান্দায় গিয়ে একাকী দাঁড়িয়েছিলাম। সাগরের দিকে তাকিয়ে রয়েছিলাম বিনম্র দৃষ্টিতে — সূর্য ডুবে গিয়েছিল আগেই সমুদ্র জলে। লাল আভাগুলো মায়াবী মনে না হয়ে কেমন বিষণ্ণ মনে হচ্ছিল।
কেয়ারটেকার এসে বলছিল — স্যার, কফি দিব?
বললাম — না।
রাতে খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি। ঘুম আসছিল না কিছুতেই। রাত গভীর হতে থাকে। মনে পড়ছিল লাবণীর কথা। ওকে আমি আজ কী বলব? ও কী চায় আমার ? আমাকে বিয়ে করতে চায়? তা কী ভাবে সম্ভব! আমার যে মায়াবতী একটি মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ি। একটা স্বপ্ন দেখলাম ঐ মেয়েটিকে নিয়ে। কী এক অদ্ভুত স্বপ্ন। কিছুটা স্পষ্ট, কিছুটা অস্পষ্ট। লাবণী আর আমি হাত ধরে সমুদ্র তীর ধরে বালিয়াড়ির উপর দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছি দিগন্তের দিকে। চলে গিয়েছি দূর আকাশের নীলে। আমাদের দুজনকে রাশি রাশি সাদা মেঘ এসে ঢেকে দেয়। আমরা যেথায় হারিয়ে গেলাম, পৃথিবীর কেউ দেখতে পেল না।
যখন ঘুম ভাঙে, তখন স্বপ্নটাও ভেঙে গেল! দেখি, ভোর হয়ে গেছে। সারা বিছানা জুড়ে অজস্র বেলী ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। রক্তজবাগুলো ছিন্নভিন্ন। বিছানায় লোধ্ররেণুর দাগ!
সকালে ব্রেকফাস্ট করে খোরশেদ আলম সাহেবকে বলি — সামান্য কিছু কাজ বাকী আছে। কাজ সেরে আমি আজই ঢাকা চলে যাব।
‘ক্ষণিকা’ ছেড়ে যখন চলে আসি, তখন খোরশেদ আলম সাহেবকে একবার বলতে চেয়েছিলাম– লাবণীকে একটু ডাকুন — ওকে একটু বলে যাই। কিন্তু বলা হলো না। রাতের লাবণী এখানে রাতের ক্ষণিকা হয়েই থাকল।
তারপর অনেক বছর চলে গেছে। এখনও কোনও
রাত্রি প্রহরে ঘুম ভেঙে গেলে একাকী বারান্দায় যেয়ে পায়চারি করি — খুঁজি অনেক দূরের সমুদ্র, চোখ মেলে দেখবার চেষ্টা করি সাগর তীরের তারার আকাশ। আলো খুঁজি ঝাউবনের জোনাকির! শুনতে পাই বহু আগের নীরব জলের শব্দ! এই অস্তবেলায় একটু আফসোস তো হয়-ই! লাবণীর দুঃখটা কী ছিল? কেনই তা জানতে চাইনি?
~ কোয়েল তালুকদার
Koyel Talukder