রুকুন খান
রুকুন খান

ছোট ভাইয়ের মৃত্যু

আত্মগত গদ্য

ছোট ভাইয়ের মৃত্যু

🏞️

তৈমুর খান

🇱🇨

ছোট ভাইয়ের লাশ খুব ভারী লাগছিল। এ কাঁধ থেকে ও কাঁধ বারবার বদল করছিলাম। এর আগেও বহু লাশ কাঁধে নিয়ে গেছি, কিন্তু এত ভারী লাগেনি। এত ভারী লাগার কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বড়োর কাঁধে ছোটোর যাত্রা বলেই স্নেহের ওজন এত ভারী ছিল। তবু নিয়ে গেলাম কবরস্থান অবধি। নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। সকলের একই পরিণতি, কিন্তু তবু হৃদয় এ কথা মেনে নিচ্ছিল না। বুকের ভিতরটা বারবার হাহাকার করে উঠছিল।

 আমার থেকে কুড়ি বছরের ছোট এবং সব ভাই-বোনের ছোট ভাই রুকুন, হ্যাঁ রুকুন খান। ৩৫ বছর বয়স এখনও পূর্ণ হয়নি। একটি মাত্র ১০ বছরের সন্তান আর স্ত্রীকে রেখে সে চলে গেল জীবনের পরপারে। শেষ মুহূর্তে বাঁচার আকুতি জানিয়েও সে আর কোনো আয়ুর বোনাস পেল না। তাই ছুটি নিতে হল। আমাদের সকলকে এটা মেনে নিতে কষ্ট হলেও কারও কিছুই করার ছিল না।

   তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছিল সে। কী কারণে শেষ করছিল, তা খোলসা করে একবারও বলেনি। শুধু বলেছিল, কষ্ট ভুলে থাকার জন্যই নেশা করি। জানি এ নেশার পরিণতি ভয়ংকর, তবু এরকম কষ্ট ভুলে থাকার কোনো উপায় নেই। 

 —কী  কষ্ট তোর?

—তোমাদের বলে কী করব? কেউ এ কষ্ট দূর করতে পারবে না। আমার জীবন দিয়ে তবেই এ কষ্টের পরিসমাপ্তি ঘটবে।

—আমরা কি চেষ্টা করতে পারি না?

—না, তা হয় না। তোমাদের নিজেদের সংসার আছে, সংসারে টানাপোড়েন আছে। নিজেকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত, আমার কথা ভাববে কেন?

   তবুও ভেবেছিলাম তার কথা। কিন্তু ভেবেও আর শেষ মুহূর্তে রক্ষা করা গেল না। ততদিনে লিভার ক্যান্সার তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। ভেতর ভেতর কষ্ট হলেও সে প্রকাশ করেনি। জ্বালাযন্ত্রণা মুখ বুজেই সহ্য করেছে। চোখেমুখে মৃত্যুর ঘোর। প্রথম চিকিৎসার দিনেই ডাক্তার বলেছিল, ‘মাস ছয়েক আয়ু’। তবে একটু মেনে-বুঝে চললে বছর পাঁচেকও টিকে যেতে পারে। কিন্তু তা আর সম্ভব হল না, পাঁচ মাসের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল।

কিসের কষ্ট ছিল ভাইয়ের?

গ্রামীণ কৃষি উন্নয়ন সমবায় ব্যাংকের সামান্য কর্মচারী। মাত্র ৬ হাজার টাকা বেতন। তাতেই সংসার চলে যেত কোনোরকম ভাবে। কিন্তু শখ-আল্লাদ আনন্দ-উৎসব উদযাপনে বাড়তি কোনো আয়ের উৎস ছিল না। মাঝে মাঝে তাই নেশা হয়ে পড়েছিল লটারির টিকিট কাটার। একবার লটারিতে ১০ হাজার টাকা পেলেও, দীর্ঘদিন আর কিছুই পাওয়া যায়নি। লটারির টিকিটও বাকিতে বাকিতে কাটা চলত। প্রতিদিনই আশা জাগত,এই বুঝি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে। আগামিতে নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু তা আর হত না। টিকিট কাটার ঋণ একনাগাড়ে বেড়েই চলত। ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গেছিল এই ঋণ।

   স্বামী বিচ্ছিন্না এক প্রতিবেশিনির বাড়িতে তার ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর উদ্দেশ্যে যাতায়াত ছিল। সেই সুবাদে তার কাছেই মাদকদ্রব্য গ্রহণের সুযোগ ঘটে। প্রথম প্রথম খুব কম হলেও পরবর্তীতে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। ওই প্রতিবেশিনির সোনার অলংকারপাতি নিয়ে চড়া সুদে বন্ধক রেখে বেশ কিছু টাকা নিজ স্ত্রীর চিকিৎসায় ব্যয় করে ফেলে। বাকি টাকা সংসারের খরচে লাগায়। ২০১৯-২০-২১ লকডাউনের সময়কালে সমবায় ব্যাংকে সামান্য বেতনটুকুও বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় সংসার প্রায় অচল। নিজের হাতের আংটি,সোনার চেন,স্ত্রীর অলংকারপাতিও একে একে সব বিক্রি হয়ে যায়। দিশেহারা হয়ে পড়ে জীবন। পারিপার্শ্বিক আত্মীয়-স্বজন থেকে সাহায্য এলেও তা মরুভূমির কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির মতো মনে হয়। তখন প্রতিবেশিনির সঙ্গে মাদক দ্রব্য সেবনে আরও তৎপরতা বাড়ে। ‘নিজেকে ভুলিয়ে রাখি’ এই তত্ত্ব থেকেই পরিষেবা তীব্র হয়ে ওঠে। সবাই নিজের নিজের ছায়া মাপতেই ব্যস্ত। ছোটভাই যে ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে চলেছে তার খোঁজ আর কেউ রাখেনি। কাউকে সে-ও বলেনি তার এই অসামর্থ্য অসামঞ্জস্য বিপন্ন অন্তরায়ের কথা। বাইরে যাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে, স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে মুখে হাসি নিয়েই বলেছে, ‘আমি খুব ভালো আছি। আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।’

  কিন্তু সেই দিনই আমরা জানতে পেরেছিলাম, যেদিন একদল পাওনাদার বাড়িতে চড়াও হয়ে তাকে মারার উপক্রম করে। পাওনাদাররা ছিল— কেউ কেউ নেশার দ্রব্য বিক্রেতা; কেউ কেউ লটারির টিকিট বিক্রেতা; কেউ কেউ সুদের মহাজন। সকলকে সেদিন তার তরফেই আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল—’কয়েক কিস্তিতেই আপনাদের টাকা পরিশোধ করে দেওয়া হবে।’ তারপর সামান্য জমি জায়গা বিক্রি করে পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করা হয়। বাড়ির সকলেই ভাবে, যাক এবারের মতো মান সম্মান বাঁচানো গেল। রক্ষা পেল ঋণের বোঝা থেকেও।

  কিন্তু হায়, ভেতরে ভেতরে তখনো কত লুকোনো গর্ত ছিল তথা ‘ব্ল্যাকহোল’ ছিল তা আমরা ভাবতে পারিনি। পরবর্তীতে লকডাউন উঠে গেলে কাজকর্ম সচরাচর চলতে থাকে। ব্যাংকও খুলে যায়। কিন্তু অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজেকর্মে মন দিতে পারে না। অভিযোগ, দোষারোপ, উদাসীনতা নিয়েই  অফিসে হাজিরা চলতে থাকে। আর এক বছর যেতে না যেতেই ধরা পড়ে যায় লিভার ক্যান্সারের এই ছোবলের ক্ষত। 

  বাড়ির ছোটছেলে এই ছোটভাই সকলেরই আদরের ছিল এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার এই পরিণতি ঝড়ের গতিতেই ঘটে চলেছিল। দীর্ঘদিন আমার বাহিরে অবস্থান, অন্যান্য ভাইরা বিছিন্ন, ভিন্ন ভিন্ন সংসারের যাত্রী। কেউ কারও দিকেই তেমনভাবে ঝুঁকতে পারত না। প্রায় অভিভাবকহীন অবস্থা। সাংসারিক জীবনে অর্থহীনতাই তাকে বিভ্রান্ত করে চলেছিল। তাই কোনো সুখের পথই সে নাগালে পায়নি। সর্বত্রই তাড়া খেয়েছিল। ঘরে বাহিরে এই তাড়া খাওয়া জীবন তাকে স্থিরতা এনে দেয়নি। শেষ দিকে অপমান প্রায় গা-সওয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বিবেক, চেতনা, মনুষ্যত্ব সে কখনো হারায়নি।

  মৃত্যুকালে সে কোনো অভিযোগও করেনি কারও নামেই। শুধু বারবার বলেছিল, ‘যত ঋণ হোক আমি পরিশোধ করে যাব।’

 দেয়ালের হাংগারে তার পরিধেয় বস্ত্রগুলি এখনো ঝুলে আছে। তার ভাত খাওয়া থালাটি অনেক শূন্যতা নিয়ে এখনো তাকিয়ে আছে। তার ঘামের দাগ লাগা বালিশটি এখনো পড়ে আছে চুপচাপ। শুধু সে নেই। গাড়ি থামিয়ে চুপচাপ ঘরে ঢুকে থমকে আছি অনেকক্ষণ। হ্যাঁ, এই ঘরেই আমি থাকতাম। ছোটভাই তখনও স্কুলছাত্র। আমার প্রথম সন্তান হলে সে-ই তাকে কোলে নিয়ে দোল খাওয়াতো। বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেত। ঘুঘু-ঘু বলে হাঁটুর ওপর নিয়ে তুলে ধরত। আজ তার সন্তানটি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কী বলে সান্ত্বনা দেবো ভেবে পেলাম না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম, আর বললাম, ‘তুমি বড় হও,অনেক বড় হও।’

 আমাদের মৃত্যুগুলি এমনি করেই আসে। এমনি করেই কাঁদায়। এমনি করেই নীরব করে চলে যায়।

রুকুন খান
রুকুন খান

Leave a Reply