পরেশ মণ্ডল

পরেশ মণ্ডল

কবিতা যখন জীবনের ডায়েরি

তৈমুর খান 

🍁

কবিতা পড়ি না, কবিতাই পড়িয়ে নেয়। খুব কম জনের কবিতাই পড়িয়ে নিতে পেরেছে। আজ যে কাব্যটি পড়তে যাচ্ছি তা রীতিমতো আমাকে পড়িয়ে নিচ্ছে। কাব্যটি লিখেছেন অনেকদিন আগেই ষাট বছর অতিক্রম করা এক কবি এবং আশ্চর্যের বিষয় হল এটিই তাঁর প্রথম কাব্য। এমন কবি আমাদের দেশে আছে তা আজ আমি প্রথম জানলাম। স্বাভাবিকভাবেই এই কবির প্রতি আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। যৌবনের অদম্য উচ্ছ্বাস, বিশ্বকে শাসন করার স্বপ্ন, তারুণ্যের দীপ্ত কোলাহলকে এতদিন কিভাবে তিনি সহ্য করেছিলেন? যাঁর কবিতায় ছিল প্রবল শব্দের অব্যর্থ ক্ষেপণ, রূপ-ঐশ্বর্যের মায়াঘন আবেশ, প্রাণ-আবেগের যৌবনজোশ এবং বোধের মানবীয় পরিজ্ঞান। তাছাড়া সংবেদনশীল হৃদয়ের স্পন্দন এবং পরিশীলিত আবেগের কারুকাঞ্চনকে প্রতিস্থাপন করার কৌশল। 

কাব্যটি পড়তে পড়তে মনে পড়ল 

আমেরিকান কবি এমিলি এলিজাবেথ ডিকিনসন (১৮৩০-১৮৮৬)-এর কথা, যিনি জীবিত সময়ে খুব কম পরিচিত, কিন্তু পরবর্তীতে  আমেরিকান কবিতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে বিবেচিত হন। ‘নির্বাচিত চিঠি’ সংকলনে তিনি লিখেছেন:

“আমি যদি একটি বই পড়ি এবং এটি আমার সমস্ত শরীরকে এত ঠান্ডা করে দেয় যে কোনো আগুন আমাকে উষ্ণ করতে পারে না, আমি জানি এটিই কবিতা। যদি আমি শারীরিকভাবে অনুভব করি যে আমার মাথার উপরের অংশটি খুলে ফেলা হয়েছে, আমি জানি এটিই কবিতা। এই আমি এটাই জানি একমাত্র উপায়। অন্য কোনো উপায় আছে কি?”

অনুভূতি যখন আত্মার সঙ্গে সমানুভূতিতে মিশে যায়, কবির বোধের সঙ্গে পাঠকও চলতে শুরু করেন— তখন এরকমটিই হওয়া যথার্থ। এতক্ষণ ধরে যে কবির কথা বললাম তিনি হলেন যাযাতি দেবল ওর্ফে পরেশ মণ্ডল (১৯৫৪)। প্রকাশিত কাব্যের নাম ‘শিকড়ে মাটির ঘ্রাণ’ (ডিসেম্বর ২০২২)।

 ‘শিকড়ে মাটির ঘ্রাণ’ মোট ৫৭ টি কবিতা নিয়ে তার বৃত্ত পূর্ণ করেছে। যা সৎভাবে লেখা যায়, যে লেখার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা থাকে না, নিজের অবস্থান আর শিকড়ের সন্ধান দেন যে লেখায় — সেই লেখা যে শিল্পের থেকেও বড় প্রাণের মহিমায় , অকপটতায়, সারল্যে ও আন্তরিকতায় তা বলাই বাহুল্য। যুগের বিবর্তনে মানুষের জীবনযাত্রায় কত পরিবর্তন এসেছে, প্রাচীন মূল্যবোধের বদলে কিভাবে আত্মসুখের স্বার্থপর জীবনের উদ্ভব ঘটেছে, সম্পর্কের বাঁধন ছিন্ন হয়েছে এবং সমাজ সংস্কৃতিতেও অবক্ষয়ের প্রভাব পড়েছে সেইসব বিষয় নিয়েই এই কাব্যের কবিতাগুলি। ডাক পিয়নের চিঠির জন্য আর কেউ উন্মুখ হয়ে থাকে না। শহর ঢুকে গেছে গ্রামে। সদরখোলা ঘর আর নেই। দুয়ার এখন গেট, সেখানে হাঁকডাকের বদলে ডোরবেল বাজাতে হয়। পাঁচিলে সিম-বরবটি-লাউয়ের লতাও থাকে না।মাধবীলতাও দোলে না। তার বদলে বিদেশি ফুল বোগেনভেলিয়া,উঠোনে সাইকাস এডেনিয়াম। ‘মৎস্যগন্ধারা আজ হাউসকোটে প্রসাধনে সত্যবতী।’ ছুটন্ত সময় ছুটে ছুটে চলেছে মানুষকে নিয়েই।

 একদিকে অতীত স্মৃতির পৃষ্ঠা উল্টিয়েছেন কবি, সেখানে প্রেম-স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার রঙিন সমারোহ উজানের হীরাকুচি ঢেউ ঠেলে মৎস্যকন্যার দেশে যাবার উচ্ছ্বাস ছিল। রৌরবের রুদ্ধ দ্বারদেশ ভেঙে আশ্লেষে জড়ানোর কথা ছিল। তারপর রুমালের বিড়াল হয়ে যাওয়ার গল্পও বাস্তবে  ফিরে আসবে। কিন্তু লুকোচুরির বিভ্রমে সব হারিয়ে গেছে। কবি নিঃস্ব হয়ে নিজের ছায়ায় দাঁড়িয়েছেন। ‘ঈশ্বর কণা অথবা শূন্যমাত্রা’য় যা প্রাপ্তি ঘটেছে অকপটে উল্লেখ করেছেন:

“সাদা বিশ্বাস উদাসীন আশ্রয়কে যেমন বানিয়ে তোলে

বেমালুম জতুগৃহ!

হা নিষাদ! আহা মহাকাব্যিক স্বার্থে বলি নিষাদ!

সেই রাজন্য মোহ।”

নিষাদের কাছেই তিরবিদ্ধ যন্ত্রণাদগ্ধ জীবনপর্ব অতিবাহিত করেছেন। ‘রাজন্যমোহ’ তাই মহার্ঘ্য হয়ে উঠেছে। পৌরাণিক চেতনার মধ্যেও জীবনের ব্যাপ্তি ও সঞ্চরণ কবি বারবার অনুভব করেন। মহাকাব্যিক প্রশ্রয় থেকে নিজেকে তুলে আনেন।আবার ভৌগোলিক চেতনার মধ্যে মানবিক কিংবদন্তিরও সূত্র খুঁজে পান ‘পুরীতে বিষ্ণুপুরী ঘরানার মেয়েটি’তে:

“এইমাত্র সমুদ্র থেকে ছিটকে এলো

বিষ্ণুপুরী ঘরানার যে মেয়েটি,

নাকে তিলফুল, জামায় ছোপ ছোপ ধ্বনিতত্ত্ব

বিভাজিকায় জঙ্গলগন্ধ;

জলের আগুনে স্নাতা বাড়বকন্যা!”

প্রকৃতির সঙ্গে মানবীয় সামঞ্জস্য গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। নীল জ্যোৎস্নায় ভাত মেখে খাওয়ার অদ্ভুত দৃশ্যও তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। আবার চাঁদ যে দুঃখের কথা শোনে না, স্বপ্নের কথা বলে না, অব্যক্ত শব্দের গোপন দীর্ঘশ্বাস জানতে পারে না তা জানিয়ে দিয়েছেন। রোমান্টিকতা থাকলেও কবির উপলব্ধিতে তার মৃত্যু ঘটেছে। বেড়ায় অপরাজিতার লতা তুলে দিলেও রাতের মতন দিন কাটান। যে যার মতন একলা থাকেন। স্বজন নিয়ে সুজন হয়ে। 

 কখনো বিষাদের গান হয়ে, কখনো রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের শোষিত মানব হয়ে , কখনো নিজের কাঁধেই নিজের লাশ হয়ে কবি আত্মসমীক্ষায়

বিভোর হয়েছেন।এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছেও সীমানা ছাড়তে পারেননি।দিনগুলি রাতের মতো কেটেছে। কবিতার কাছে গিয়েও দেখেছেন তা অক্ষরহীন। ভালোবাসা দিতে গিয়েও বুঝেছেন:

“মিছে কথা!

তোমারও রয়েছে কিছু ব্যথা!

গোপনে অন্তরালে:

ভেসেছ চোখের জলে…”

এই চোখের জলের কাছেই নিজের হৃদয় দহনের কথা তুলে ধরেছেন। মাঠ পেরোনো নীরবতা,ফসল ভালোবাসায়,শিশির ধোয়া সোঁদা গন্ধ আর মিষ্টি সরলতা এক দুঃখী রূপকথার জন্ম দিয়েছে। গ্রামজীবন, আকাশ নক্ষত্র, অশ্বথতলা, জোনাকির ঝিকিমিকি, রাতচরা পাখি,চামচিকে সব নিয়ে দৃশ্যমায়া। কন্ঠে বাউল লালন সাঁই ,কদমখণ্ডী ঘাট, অঙ্গ সাধন, অনঙ্গ সন্নিধান,বর্ষামঙ্গল সব ভিড় করে এসেছে। নিটোল কবিতার কাছে ‘কবিজন্ম’ ব্যাখ্যা করেছেন।কখনো তা সান্ধ্য ভাষায় গুপ্তবিন্দু সাধনের ইচ্ছা হয়ে উঠেছে। এত অন্তরায়, এত শূন্যতা তবুও মানুষকে কাছে ডেকেছেন অন্তরের কোনো তাগিদ থেকে। কাব্যের শেষ কবিতায় তাই বলেছেন:

“যদিও বিষাদ নিত্যসঙ্গী

তবুও এসো

একটু বসো

যদিও বিষাদ…”

বিষাদ যতই জীবনকে বেঁধে রাখুক, চলার পথকে অন্ধকার করে দিক তবুও হৃদয়ে প্রেম আছে, সব অন্তরায় ভেদ করে প্রেমের মহিমায় মহিমান্বিত করে দিতে চান এই জগৎকে। সহজ আবেদনে ভরপুর কবিতাগুলি আমাদের জীবনেরই রোদছায়ায়, সুখ-দুঃখে, স্বপ্নে-ভালোবাসায় মেদুর অভীপ্সা নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সত্যিকারের যোদ্ধারা বেদনা নিয়ে বড় হয় (Real warriors are raised with pain.) জীবনের ডায়েরিতে এ-কথাই তো লেখা আছে। এই কাব্যটিতে কবিও বেদনার যোদ্ধা হয়ে উঠেছেন।

🍁

শিকড়ে মাটির ঘ্রাণ: যযাতি দেবল, নাটমন্দির, আশা নিকেতন, রবীন্দ্রপল্লি, নর্থ লেক রোড, পুরুলিয়া ৭২৩১০১, মূল্য ১২০ টাকা। প্রচ্ছদ জিশান রায়।

ছবিতে পরেশ মণ্ডল ওরফে যযাতি দেবল 

পরেশ মণ্ডল
কবি তৈমুর খান

Leave a Reply