প্রদীপ চক্রবর্তীর কবিতা, ভাষাতীত শূন্যতার স্বয়ংক্রিয় আবর্তন
🍁
তৈমুর খান
🍁
সাহিত্য-শিল্পে আধুনিকতাবাদ, যুক্তি,বিজ্ঞান, মানবতাবাদ এবং প্রচলিত শৈল্পিক ধ্যানধারণার বিষয়ভিত্তিক একমুখীনতাকে পুরোপুরি পরিহার করে অধুনান্তিক সাহিত্য-শিল্পের পথে যাঁরা ব্রতী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ৯০ দশকের উল্লেখযোগ্য কবি প্রদীপ চক্রবর্তী(১৯৭২)। ২০০৫ থেকে ২০২৩ সময়কালে প্রকাশিত তাঁর ৮টি কাব্যগ্রন্থ থেকে প্রায় দশ শতাংশ কবিতা নিয়ে ‘নির্বাচিত কবিতা'(২০২৩) প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল: ‘রেনবো গ্যালারিনী’, ‘ছাতিম হরবোলা’, ‘সুফি রং’, ‘৯ আঁকা ০’, ‘অব্যবহৃত প্রজাপতিগুলো’, ‘জলের খোলাম’, ‘খড়ের রাক্ষস’, এবং ‘তানাশাহী’। কাব্যের নামকরণগুলিতেই বোঝা যায় কবি কতখানি ব্যতিক্রমী হতে চেয়েছেন। কাব্যের সংকলন প্রসঙ্গে কবি নিজেই উল্লেখ করেছেন: “চেয়েছিলাম, নিজের কাল্পনিক অভিজ্ঞতালব্ধ ভাবনার জগতের কাছাকাছি আমার শব্দগুলোকে পৌঁছে দিতে। যে ভ্রামণিক মন অখণ্ড কাল, সর্পব্যাপী জগৎ এবং সর্বত্র স্পন্দিত অগণ্য জলবিম্বের মতো উত্থিত নিমীলিত জীবন, এই তিনের সন্নিপাতে তৈরি আলোছায়ার বহুস্তরীয় রহস্য অব্যক্তে মেলানো জীবনের কলহাসি নুড়ির মতো বাজতে বাজতে খাদে-খোঁদলে গড়িয়ে যাওয়া জীবনের অংশগুলোকে কবিতায় রেখে দিতে।” জীবনের এই রহস্যময়তা, এই শূন্য ভেদ, এই নাথিংনেস নিয়েই কবিতাকে প্রকরণহীন অবিন্যস্তযাপনের বহুরৈখিক প্রতিস্পর্শী জ্ঞাপনের মাধ্যম করে তুলেছেন। সেখানে বিশেষণের স্বাভাবিকতা যেমন নেই, তেমনি জোড় শব্দের বিনির্মাণে যে ধারার প্রবাহ তাতেও লক্ষ্যভ্রষ্ট বিভ্রান্তির শিকার হতে হয়। বিষয় খোঁজা কবিতা পাঠককে পদে পদে যেমন টক্কর খেতে হয়, তেমনি কবিতার আলোচনা বা সমালোচনায়ও পরিচিত পথে অবগাহন করা চলে না। সেখানেও হতাশার জন্ম হতে পারে। তবে অন্বয়গত বৈসাদৃশ্য থাকলেও একটি ব্যক্তির যাপনক্রিয়ার ব্যাপ্তিকে অস্বীকার করা যায় না। সেখানেই বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, আঞ্চলিকতা, প্রাচীন ও নবীনের সমাবেশ কার্যত কালসীমাহীন জাদুকরের মিউজিয়ামে পরিণত করে। সেখানে যেমন সময়কে ছুঁতে পারি, তেমনি বস্তুকে এবং বস্তুর আকৃতিকেও স্পর্শ করতে পারি। তেমনি ইতিহাস ও দর্শনেও সঞ্চারিত হতে পারি। ভাবনাকে লৌকিক-অলৌকিকতার সীমানা পার করে মুক্ত হতে পারি। কল্পনাকে বিনির্মাণের নিজস্ব আলোয় অনুগত করে তুলতে পারি। কবি যখন লেখেন:
“তুলো তুলো কৈশোরক শব্দরা উড়ছে। যেভাবে চমরিগাই-এর লোমশ পোশাক পরে গুহার আবডাল থেকে জ্যোৎস্নারাতে একদিন পাথরের অস্ত্র ছুঁড়ে দিত যৌনকাতর ইভ, অজানা টগবগে পুরুষালি মাংসের নুনমরিচ গন্ধে, শব্দরা ঝিলম নদীর পাশে পাশে হাঁটছে। হাজার হাজার বছরের চৈত্র সাংকেতিক আলেয়ার ধুলোট লিপি, বৌদ্ধমঠ, নির্বাণশুদ্ধতা, চামচিকে ও বাদুড়ের ঝুলন্ত মাস্তুল সুলভ ভাঙা ডানা, মাকড়সার মিল্কসিল্কি ফাঁদ ছিঁড়ে শব্দরা এগিয়ে আসছে, শূন্য জলের ছায়ায়।” (নক্ষত্রের জলবিন্দু)।
তখন কতকগুলো বুদবুদ, নিয়ন্ত্রণহীন শব্দদৃশ্যের ঘোর কাল্পনিক মোচড়ে আনচান করে ওঠা ক্রিয়ায় ধাক্কা খায় আর প্রাচীন জীবনবাদের প্রয়োগে জেগে ওঠে। সময়ের অন্তরাল ভেঙে প্রবল ধারাস্রোতকে আত্মস্থ করেই এগিয়ে যাবার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। মিশ্র-অনুষঙ্গের প্রাবল্যে আত্মবিস্তারের এই ক্ষেপণ কখনো শেষ হয় না। সায়ন্তন সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে যাবার প্রক্রিয়া জারি থাকে। কখনো তা গ্রিল ভেঙে ঝোড়ো ছাঁট, নীলমন্তাজে বৃষ্টি সফর। কখনো ছেঁড়াপাখির দোল-দোল শরীর দমকে ভেঙে যাওয়া তিসি ফুলের পাপড়ি। বর্ণনায় প্রচলিত রীতিবিন্যাসের পথে কবি যেতে চাননি। এক স্বয়ংক্রিয় স্বজ্ঞায় ধারণাকৃত ধারণাকেই প্রশ্রয় করে বিস্তৃত করেছেন ভ্রাম্যবোধির পর্যায়গুলিকে। মানব সভ্যতার ইতিহাস, আখ্যান, প্রাগৈতিহাসিক জীবনাচারের পরিচয় যেমন উঠে এসেছে, তেমনি আধুনিক প্রজ্ঞাপারমিতায় প্রবেশ করেও প্রাচীন ঐতিহ্যের অন্বয়কে অনুধাবনের মধ্য দিয়ে বহুমুখী করে তুলেছেন। ‘ছাতিম হরবোলা’য় লিখেছেন:
“অলীক ব্লেকের স্ল্যাশ্
জলের এ-প্লাস শুষে নিচ্ছে হার্টবিট
ক্লোরোকে ফিল করতে
ঠোঁটের শিষ ফুরিয়েছে ঠোঁটে”
প্রচলিত শব্দবোধ নেই। বিষয় নেই। দর্শনও নেই। বিজ্ঞানও নেই। শব্দের বিনির্মাণ এবং কার্যকারণের উল্লঙ্ঘন, বিশেষণ ব্যবহারের ভিন্নতা সবই বাংলা ভাষা ও ভাষারীতিকে এক নতুন শিহরন দেবার কৌশল আছে। অধুনাান্তিক কবিতারীতির পথ অনুসরণ করেও তার মাঝে মাঝে জাদুবাস্তবের প্রয়োগও সচকিত করে। তাই গল্পের জন্ম হলেও গল্পগুলি পূর্বাপর সামঞ্জস্যবিহীন। ব্যবহৃত শব্দগুলিও বিনির্মাণে অর্থহীনতার ভিতর প্রবেশ করে। তখনই সৃষ্টি হয় ‘যত অনিয়মী’:
“এই সেই লবণ গৃহিণী। কনক সিন্দুর। ফৈজত। তেজস্ক্রিয় নীডল। অষ্টাদশী নদীটির অশরীরী পাখির স্বর দ্যাখো আলি আকবরে
আজ সারাদিন ঘুমন্ত জনতরঙ্গ। আবছায়ায় বেজে যাচ্ছে আমার যেটুকু দেখা পেতেছো। এখন মাটিতে নেমে এসে বুঁদ হয়। দেয়ালা বদলায়
দেখি কস্তাপাড় যৌনতা। রহস্যের জোড়া বিনুনি। একটা আনোখা বাসন-ধোয়া সোঁদা গন্ধ। ভেজা ভেজা সুরকির গলি। আমাকে ডাকছে পিঁপড়ের ডিম…”
উদ্ধৃত অংশটুকুতে দেখা যাচ্ছে কাঙ্ক্ষিত বা প্রচলিত শব্দরীতির ব্যবহার পাল্টে গেছে। লবণ গৃহিণী, কনক সিঁদুর, অষ্টাদশী নদী, ঘুমন্ত জনতরঙ্গ, কস্তাপাড় যৌনতা প্রভৃতি শব্দজোড়গুলির ভিন্নতা চোখে পড়ে। সমস্ত কাব্যজুড়েই এরকম শব্দের ভিড় লক্ষ করা যাবে। লোকায়ত সাহিত্য ও দর্শনের এবং চেতনার নিবিড় সংযোগ থেকেই তা উত্থিত হয়। সবকিছুর মূলেই থাকে কেন্দ্রাতিগ এক শেকড় সংযোগ। কাব্যের বিচ্ছিন্নতা, দৃশ্য, টুকরো বাক্য,শূন্যতার বিন্যাস অথবা আরোপ, অর্থহীনতার প্রজ্ঞা, নীরবতার স্পেস প্রভৃতি সব কিছুরই এক সমন্বিত আকর্ষণ যাকে আলাদা করে ভাববার অবকাশ নেই। স্থান-কাল, প্রাচীন সাহিত্য, পৌরাণিক মিথ, উদ্ধৃতি সহযোগে এই শেকড় সংযোগের সমন্বয় পোস্ট-মডার্নের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। কবিতাতে বারবার সেসব উঠে এসেছে। আন্টাবাংলা ও কুড়ানিল, লবটুলিয়া—বইহার, আনন্দ পাঠশালা, আদম ও কস্তুরাপাখির ডাক, এবং ছিন্নপত্র, অন্তরঙ্গ অর্কেস্ট্রা, মধুমতী: এক ভারতীয় টাইম মেশিন, হয়তো রোববার, বিনোদবিহারীর ছবি থেকে, ডাকহরকরা, রক্তকরবীর উৎস শুষে নিই…, ব্রহ্মসূত্র ও একটি খসড়া কবিতা, খড়ের রাক্ষস, স্কাইস্ক্রেপারের গায়ে পাখিদের আত্মহত্যা প্রভৃতি ছোট-বড়ো কবিতাগুলিতে বারবার তা ফিরে এসেছে। ‘তানাশাহী’ কাব্যে লিখেছেন:
“মহুল রঙ
হোমারের নৌকো
হলুদ অরণ্যদেব
কার্বন মালিকা”
অথবা
“মধ্যে পথ
পুরনো ঠান্ডার গন্ধ
ঘরের পরিসরে
খুন নামিয়ে রাখলো মগজ
পাখিদের হারমোনি: হাঁসুলিবাঁকের উপকথা
ইয়াসিনের ঘোড়া মাত্রাময় মুনাফা”
সব দৃশ্য বা দৃশ্যকল্পে আত্মার সাথে সরাসরি কথা বলার জন্য সত্যতা অমূল্য, বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞানের অস্তিত্বকে বারবার অস্বীকার করা হয়েছে। কারণ সব মৌলিকতাই অস্তিত্বহীন, তাই বিষয় ধরে চলা নেই। বাগান চর্চা, পাখি চর্চা, জলের কাছে ফেরা, শেকড়ের কাছে ফেরা, শূন্যতার রং তুলে শূন্যতাতেই বপন করা, উন্মুক্তির নৈরাজ্য, নিস্পন্দ নীরবতার ব্যাখ্যাহীন যুক্তিহীন শৃঙ্খলাহীন পর্যায় ফিরে ফিরে আসে। ভাষাতীত শূন্যতায় স্বয়ংক্রিয় ঘূর্ণমান চক্র আবর্তিত হয়। সবকিছুকে ধরার মধ্যেই সবকিছুকে ছাড়ার, সব কিছুর মধ্যে অবস্থান করেও শূন্যতাতেই অবগাহন চলতেই থাকে।
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও সংস্কৃতিতাত্ত্বিক জেন বাউড্রিলার্ড (১৯২৯-২০০৭) গণমাধ্যম, সমসাময়িক সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিগত যোগাযোগের বিশ্লেষণের পাশাপাশি সিমুলেশন ও অধিবাস্তবতার মতো ধারণা প্রবর্তনের জন্য বিশেষভাবে খ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর একটি বক্তব্য হল:
“Postmodernity is said to be a culture of fragmentary sensations, eclectic nostalgia, disposable simulacra, and promiscuous superficiality, in which the traditionally valued qualities of depth, coherence, meaning, originality, and authenticity are evacuated or dissolved amid the random swirl of empty signals.”
অর্থাৎ উত্তর-আধুনিকতাকে বলা হয় খণ্ডিত সংবেদন, সারগ্রাহী নস্টালজিয়া, ডিসপোজেবল সিমুলাক্রা এবং প্রমিসকিউস সুপারফিশিয়ালিটির একটি সংস্কৃতি, যেখানে গভীরতা, সুসংগততা, অর্থ, মৌলিকতা এবং সত্যতার ঐতিহ্যগতভাবে মূল্যবান গুণাবলী এলোমেলো ঘূর্ণায়মান সংকেতের মধ্যে উচ্ছেদ বা দ্রবীভূত হয়। এই কাব্যটির সঙ্গেও এই বক্তব্যের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। বিনির্মাণে সবকিছুই পাল্টে গেছে। সচলতার পরিধি বিস্তৃত হয়ে উঠেছে বলেই পাল্টানোর নিরীক্ষা ও গতিবিধি পোস্ট-মডার্ন কাব্যচেতনাকে অবধারিত করে তুলেছে। তুলনা বাচক শব্দ বা মেটাফোরিক বিশেষণ কোথাও ব্যবহৃত হয়নি। কবির কাব্যচেতনায় এই মেধাবী উত্তরণ খুব কম পাঠকের কাছেই প্রতিভাত হবে।
🍁
নির্বাচিত কবিতা: প্রদীপ চক্রবর্তী, সম্পাদনা কৌশিক চক্রবর্তী, প্রচ্ছদ সমীরণ ঘোষ, আলোপৃথিবী প্রকাশন, পঞ্চবটীপাড়া, কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান-৭১৩১৩০, মূল্য ৩০০ টাকা।
ছবিতে প্রদীপ চক্রবর্তী


প্রদীপ চক্রবর্তী