শূন্যের মায়াবী দরজায় পৌঁছানোর প্রয়াস
🍁
তৈমুর খান
🍁
আত্মহত্যার স্ব-নির্ধারিত সময় লিখে ফেলা কবি নিখিলকুমার সরকারের অমোঘ অভিযাপনের বিচিত্র শৃঙ্গারসুধারস অনিবার্য শেষের সূর্যাস্তেও প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘মারুবেহাগ'(প্রথম প্রকাশ বইমেলা ২০২৩) কাব্যে। এক রহস্যময়তার আত্মসঞ্চারে গ্রস্ত কবি নিজেকে উন্মোচিত করতে চেয়েছেন নিজেরই মোহযাপনের অন্বয়ে এবং অনন্বয়ে। তাঁর চেতনার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে কোনো মহাজাগতিক প্রশ্রয় সম্ভূত মূর্ত অলৌকিক রমণী অথবা বিশাল ব্যাপ্তিময় ক্ষেত্রসম্ভূত কল্পদ্রুম। তাহলে কি অনাগত মহাপ্রলয়ের সর্বগ্রাসী ঢেউয়ের প্রতিমা সে?
এই অনিশ্চিত জীবনপ্রবাহের এক প্রজ্ঞা থেকেই কবিতায় চারিত হয়েছে লীলায়িত নানা তরঙ্গ। জার্নিশেষের কাউন্ট ডাউন। নিজের কাছে পৌঁছানোর অন্তিম শিরোনাম। সেই শিরোনামেরই নাম দিয়েছেন ‘মারুবেহাগ’। হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি আধুনিক রাগ, যাকে রাগ বিহাগেরই একটি রূপ হিসেবে ধরা হয়। শিল্পীর সৃজনশীলতার উপর এই রাগের পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে কবিও একটি নিজস্ব বৃত্ত তৈরি করেছেন। প্রচলিত কাব্যরীতির বাইরে সমকালীন ভাষাকল্পকে ভিন্নচিন্তনের আদল দিয়েছেন। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে কাব্যের শেষ উচ্চারণে লিখেছেন:
“আমি যেন-বা সত্তাহীন সত্তা, অন্ধ পিণ্ড এক, পা টেনে টেনে/ চলেছি সেই অসম্পূর্ণতায়, যেখানে অপেক্ষা করছে/ আমার অন্তিম শিরোনাম, আত্মজ সাদা ফুলস্কেপ, আর/ আত্মহত্যার আপডেট টেকনোলজি” একদিকে আছে জীবনবীক্ষা, অন্যদিকে অনন্তজীবন অর্থাৎ ব্রহ্মজীবনের দিকে যাত্রা। একদিকে অপূর্ণতা বা অসম্পূর্ণতা, অন্যদিকে পূর্ণতায় পৌঁছানোর প্রয়াস। মোট ৩৯টি কবিতায় কবির এই শব্দের সংসার। অনন্ত পয়ারের জাগ্রত শরীরে আত্মরতির সুখের উচ্চারণ মুদ্রিত করেছেন। ‘রন্ধনপ্রণালী’ শব্দটি ব্যবহার করে কাব্যকুশালী কবি কাব্যের অনন্য স্বাদ আস্বাদন করিয়েছেন। তেমনি ‘নৃশংস’ শব্দটির ব্যবহারেও নিজস্ব শৈলীর পরিচয় দিয়েছেন। দুটি ক্ষেত্রেই শব্দের বিনির্মাণ তত্ত্ব প্রযুক্ত হয়েছে। লিখেছেন: “রন্ধনপ্রণালী অপেক্ষা করিতেছে, অথচ মন/ কোনো উদাসীন ঝুলবারান্দায় মাত্রাবর্জিত অজ্ঞাতবাসে”। “যতটা নৃশংস হলে আস্ত পাঁউরুটি অবলীলায় কেটে দু’ভাগ করা/ সম্ভব, ততটাই নির্বিকল্প নৃশংস হওয়া চায়—” এই দুটি ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে Taste of the Arts যাকে ফরাসি লেখক গুস্তাভ ফ্লোবের (১৮২১– ১৮৮০)
বলেছেন “The art of writing is the art of discovering what you believe.”
অর্থাৎ লেখার শিল্প হল আপনি যা বিশ্বাস করেন তা আবিষ্কার করার শিল্প। এখানে কবির বিশ্বাসের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করারই মুহূর্তগুলি ধরা পড়েছে। কাব্যের ‘রাক্ষস’ সিরিজে লিখেছেন নিজেরই অন্তর্গত রাক্ষস রূপের আবিষ্কারকে। ক্ষুধার্ত রাক্ষস মুখ ব্যাদান করে কবিকে মুখের ভেতর পুরে নেয়। ল্যাজা-মুড়ো, হাড়-মাংস, রক্তরস পরমানন্দে চেটেপুটে খায়। তখন এই আবিষ্কারের মধ্যেও কিউবিজম্ ভাবনারই ছায়া পড়ে। যা বাস্তবে দেখা যায় না, তাকে কবিই দেখতে পান। রাক্ষস বাংলা ভাষায় কবিতা লেখে। কবিতার প্রেমে পড়ে। রাক্ষস তার যাপিত সময়ের পরিচয় দেয়। ‘রোদ্দুর’ সিরিজেও আরশিনগরের ঠিকানা অন্বেষণ আত্মপরিক্রমারই পথে চির আকাঙ্ক্ষিত শূন্যের মায়াবী দরজায় পৌঁছানোর প্রয়াস। যেখানে মৃত্যুচেতনার ভেতরেও এক কৌতূহলী যাত্রা উপলব্ধি করা যায়। কবি লেখেন: “ভুলে সব সন্তাপ আমিও আত্ম-উড়ানে আবার/ মেলে দিই ডানা, ট্যুইটারে”। ‘দিগন্তবিলাসী অনন্তপয়ার’ এবং ‘মন্দাক্রান্তা রসিক ঢেউয়ে’ ভেসে থাকার মধ্যেই বিন্দাস জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। জীবন সম্পর্কে অকপট স্বীকারোক্তি এবং ‘যশোদি’ নাম্নী অনন্ত যৌবনার কাছে সান্নিধ্য কামনায় ‘অলৌকিক বিহ্বলতা’ নিয়ে চারিপাশের হুক্কাহুয়া শেয়ালনির্বিশেষকে নিরীক্ষণ করেছেন। তারপর নিজেকে বিবর্তনীয় বিশেষ্য, রূপান্তরকামী বিশেষণ, সহজিয়া সর্বনাম এবং অবিনশ্বর অব্যয় করে ‘কিস্তিমাতে’র দিকে নিয়ে গেছেন। মারুবেহাগের শিল্পী তো তিনি—বারবার একথা বুঝিয়েও দিয়েছেন। ‘আমি, আমার’ কবিতায় বলেছেন: “নশ্বর চুম্বনগুলি থেকে সংগৃহীত নুন নিয়ে একটু একটু করে/ আমি এক পুতুল গড়েছি, নির্বিকল্প নিজস্ব নির্জনতায়/ কোনও কাব্যভাষায় অনুবাদ করিনি তাকে/ কিংবা ক্ষুধার্ত পথের বাঁকে আই-লেভেল পোস্টার/ পুতুল আমার, আমারই রয়ে গেছে”। এই পুতুল বিনির্মাণে নিজস্ব রেশমবৃত্তের বিচিত্রগামী বহুমাত্রিক পরিচয় আছে। তার বুননে ব্রহ্মকমলের সন্নিধান যেমন আছে, তেমনি প্রাগ-ইতিহাসের রুট ম্যাপও আছে। স্বগতোক্তিপ্রায় রহস্যময় উচ্চারণে তাতে রামকৃষ্ণ কথিত নুনের পুতুলের সমুদ্রে বিলীন হওয়ার গল্পটিও প্রযুক্ত হয়েছে। বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে আত্মগোপনচারী কবির এই কাব্য এক অনন্যতা নিয়েই চিরদিন বিরাজ করবে।
🍁
মারুবেহাগ: নিখিলকুমার সরকার, আলোপৃথিবী প্রকাশন, পঞ্চবটী পাড়া, কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান-৭১৩১৩০, প্রচ্ছদ:সমীরণ ঘোষ, মূল্য ১৫০ টাকা।


Dr. Taimur Khan