338500886 517698687243418 6220483796606893520 n
338500886 517698687243418 6220483796606893520 n

বহিঃসৌর গ্রহের কাছে বারবার একটি বেতার সংকেত সনাক্ত

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর মতোই বহিঃসৌর একটি গ্রহের কাছ থেকে পুনরাবৃত্তি করা বেতার সংকেত সনাক্ত করেছেন ৷ গ্রহটি যে নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে উভয়ই পৃথিবী থেকে প্রায় ১২ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত । এই শক্তিশালী বেতার সংকেতটি ইঙ্গিত দেয় যে, পৃথিবী আকারের ঐ গ্রহটির একটি চৌম্বক ক্ষেত্র এবং সম্ভবত বায়ুমণ্ডল থাকতে পারে । উত্তর দিকে দিঙ্নির্ণায়ক (Compass) সূঁচ নির্দেশ করার পাশাপাশি পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র আমাদের এই সবুজ গ্রহের বায়ুমণ্ডলকে রক্ষা করে, যা বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন । পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র সূর্য থেকে নিয়মিতভাবে বিস্ফোরিত উচ্চ শক্তিসম্পন্ন কণা এবং প্লাজমাকে (Plasma) প্রতিফলিত করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে রক্ষা করে, যার ফলে গ্রহে জীবন টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে । গবেষকরা বলেছেন, ওয়াইজেড সেটি বি (YZ Ceti b) নামক বহিঃসৌর গ্রহে একটি চৌম্বক ক্ষেত্রের সম্ভাব্য অস্তিত্ব যা সম্ভাব্যভাবে সেই গ্রহে জীবনধারণ বা প্রাণের বাসযোগ্যতার সংকেত দিতে পারে । আমাদের সৌরজগতের বাইরে অবস্থিত বহিঃসৌর গ্রহগুলোর চারপাশে বায়ুমণ্ডল খুঁজে পাওয়া অন্যান্য বিশ্বের দিকে নির্দেশ করতে পারে যা সম্ভাব্যভাবে জীবনকে সমর্থন করার ক্ষমতা রাখে ৷ নিউ মেক্সিকোতে ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো এবং বাকনেল ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিজ্ঞানী সেবাস্তিয়ান পিনেদা (Sebastian Pineda) ও জ্যাকি ভিলাডসেন (Jackie Villadsen) ‘কার্ল জি. জানস্কি ভেরি লার্জ অ্যারে (ভিএলএ)’ বেতার দূরবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে ওয়াইজেড সেটি (YZ Ceti) নামক একটি ছোট লাল বামন নক্ষত্র থেকে নির্গত পুনরাবৃত্তিমূলক শক্তিশালী বেতার সংকেত পর্যবেক্ষণ করেছেন । বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণের সময় ঐ নক্ষত্র থেকে আসা বেতার তরঙ্গ এবং এটিকে প্রদক্ষিণকারী পৃথিবীর মতোই একটি পাথুরে বহিঃসৌর গ্রহ লক্ষ্য করেছেন, যেটিকে ওয়াইজেড সেটি বি (YZ Ceti b) বলা হয় । তারা বিস্ফোরিত এক শক্তিশালী বেতার সংকেত খুঁজে পেয়েছেন এবং বিশ্বাস করেন যে, বেতার সংকেতটি গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্র ও নক্ষত্রের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া দ্বারা তৈরি হয়েছিল । গবেষক দলটি বেতার তরঙ্গ শক্তির উপর ভিত্তি করে গবেষণাপত্রে ব্যাখ্যা করেছেন যে, ”শক্তিশালী বেতার তরঙ্গগুলো ‘প্রায়’ গ্রহের কক্ষপথের সাথে সারিবদ্ধ ছিল । এটি গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্রের কাত হওয়ার কারণেও হতে পারে । যেমন বৃহস্পতির চৌম্বক ক্ষেত্রের কাত হওয়ার মতো । কিন্তু আমরা কি দেখছি তা নিশ্চিত হওয়ার আগে আরো পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে ।” গত ০৩রা মে ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে নেচার জ্যোতির্বিজ্ঞান সাময়িকীতে (Nature Astronomy Journal) ফলাফলের বিস্তারিত একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে । পেনসিলভানিয়ার বাকনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জ্যাকি ভিলাডসেন বলেন, “আমি এই জিনিসটি দেখছি যা আগে কেউ দেখেনি ।” এছাড়া কলোরাডো বোল্ডার ইউনিভার্সিটির গবেষণা জ্যোতির্পদার্থবিদ ও গবেষণার প্রধান লেখক সেবাস্টিয়ান পিনেদা এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা প্রাথমিক বিস্ফোরণ দেখেছি এবং এটি দেখতে সুন্দর ছিল । যখন আমরা এটি আবার দেখলাম এটি খুব ইঙ্গিতপূর্ণ ছিল, ঠিক আছে, সম্ভবত আমাদের এখানে সত্যিই কিছু আছে । চৌম্বকীয় ক্ষেত্রগুলো একটি গ্রহের বায়ুমণ্ডলকে শক্তিশালী নাক্ষত্রিক বায়ু দ্বারা দূরে সরিয়ে নেয়া বা হ্রাস করা থেকে আটকাতে পারে । মূলত নক্ষত্র থেকে কণা নির্গত হয়ে সময়ের সাথে সাথে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং এটি উচ্চগতিসম্পন্ন কণা বর্ষণ করে । কোনো গ্রহ বায়ুমন্ডলের সাথে টিকে আছে কি-না তা নির্ভর করে গ্রহটির একটি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র আছে কি-না তার উপর ।” জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তত্ত্ব দিয়েছিলেন যে, গ্রহটির চৌম্বকীয় ক্ষেত্র এবং এটি যে নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে তার মধ্যে মিথস্ক্রিয়ায় নাক্ষত্রিক বেতার তরঙ্গের জন্ম দিচ্ছে, যা তারা সনাক্ত করেছেন । তবে তারা বলেছেন যে, দীর্ঘ দূরত্বে এই ধরনের তরঙ্গ শনাক্ত করতে হলে তাদের অবশ্যই খুব শক্তিশালী হতে হবে । বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুন গ্রহের এখনো চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে আমাদের সৌরজগতে । অতীতে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই গ্রহগুলোর নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্রসহ বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতির সমান বহিঃসৌর গ্রহ সনাক্ত করেছেন ৷ কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা আমাদের সৌরজগতের বাইরে ছোট পাথুরে বিশ্বের চৌম্বক ক্ষেত্র সনাক্ত করতে সক্ষম হইনি । এই রকম দূরবর্তী পৃথিবী আকৃতির ছোট গ্রহে চৌম্বক ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া আরো কঠিন কারণ চৌম্বক ক্ষেত্রগুলো মূলত অদৃশ্য । বর্তমান অনুমান হচ্ছে যে, গ্রহের চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তার নক্ষত্র দ্বারা উত্থিত প্লাজমার মধ্য দিয়ে সজোরে ধাক্কা লাগায় শক্তিশালী বেতার তরঙ্গ উৎপন্ন হচ্ছে । অধ্যাপক জ্যাকি ভিলাডসেন আরো বলেন যে, “আমরা যা করছি তা তাদের দেখার উপায় খুঁজছি । আমরা এমন গ্রহ খুঁজছি যেগুলো সত্যিই তাদের নক্ষত্রের কাছাকাছি এবং পৃথিবীর সমান আকারের । এই গ্রহগুলো তাদের নক্ষত্রের খুব কাছাকাছি যেখানে আপনি বাস করতে পারেন, কিন্তু গ্রহগুলো খুব কাছাকাছি থাকায় নক্ষত্র থেকে আসা একগুচ্ছ উপাদানের মধ্য দিয়ে চাষ বা হলকর্ষণ করে । যদি গ্রহের একটি চৌম্বক ক্ষেত্র থাকে এবং এটি পর্যাপ্ত নক্ষত্রের মধ্যে দিয়ে চষে বেড়ায়, তাহলে নক্ষত্রটি উজ্জ্বল বেতার তরঙ্গ নির্গত করবে ।” বহিঃসৌর গ্রহ ‘ওয়াইজেড সেটি বি’ তার মূল নক্ষত্র ‘ওয়াইজেড সেটি’ এর খুব কাছাকাছি হওয়ায় চারপাশে একটি একক কক্ষপথ সম্পূর্ণ করতে মাত্র ০২ পৃথিবী দিন সময় নেয় । এদিকে, আমাদের সূর্যের সবচেয়ে কাছের ও সৌরজগতের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত কক্ষপথ হচ্ছে বুধ গ্রহের, যা সূর্যের চারপাশে একটি কক্ষপথ (আনুকূল্য বা অধিস্থাপন বা Lap) সম্পূর্ণ করতে ৮৮ পৃথিবী দিন সময় নেয় । যখন ‘ওয়াইজেড সেটি বি’ গ্রহটি তার মূল নক্ষত্রের চারপাশে কশাঘাত (Whips) দেয় তখন নক্ষত্র থেকে গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্রের সাথে প্লাজমার (Plasma) সংঘর্ষ হয়, লাফাইয়া সরিয়া যায় এবং নক্ষত্রের চৌম্বক ক্ষেত্রের সাথে যোগাযোগ করে । এই সমস্ত তেজোময় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং শক্তিশালী বেতার তরঙ্গ মুক্তি বা ছেড়ে দেয় যা পৃথিবীতে সনাক্ত করা যায় । গবেষকরা গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তি নির্ধারণ করতে তাদের সনাক্ত করা বেতার তরঙ্গ পরিমাপ করেছেন । জ্যোতির্বিজ্ঞানী সেবাস্টিয়ান পিনেদা বলেন, ”নক্ষত্রের চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে এটি আমাদের নতুন তথ্য দিচ্ছে । এই ধারণাটিকেই আমরা বলি ‘বহির্ভূত মহাকাশ আবহাওয়া’ ।” আমাদের সৌরজগতে সূর্যের ক্রিয়াকলাপ মহাকাশে আবহাওয়া তৈরি করতে পারে যা পৃথিবীতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে । সূর্য থেকে শক্তিশালী বিস্ফোরণ বা সৌর অগ্নি শিখা বিস্তারণের ফলে বৈশ্বিক টেলি-বেতার যোগাযোগ, বৈদ্যুতিক শক্তির বিদ্যুদ্বাহী তারজালি, বিমান-নৌযাত্রা সংকেতকে প্রভাবিত করতে পারে । কৃত্রিম উপগ্রহ (Satellite), মহাকাশযান এবং নভোচারী বা মহাকাশচারীদের জন্যও ঝুঁকি তৈরি করতে পারে । এছাড়া পৃথিবীর মেরুগুলোর কাছে মেরুপ্রভা বা আকাশে দৃষ্ট আলোকচ্ছটা বা মেরুজ্যোতি (Aurora borealis / Aurora australis) বা উত্তরের আলোর (Northern light) মতো চকচকে আলো দেখাতে পারে । বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, ‘ওয়াইজেড সেটি’ নক্ষত্র এবং এর ‘ওয়াইজেড সেটি বি’ গ্রহের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া একটি মেরুপ্রভা তৈরি করে ৷ কিন্তু এই উজ্জ্বল রঙিন আলোক প্রদর্শনটি আসলে নক্ষত্রের উপর সঞ্চালিত হয় । সেবাস্টিয়ান পিনেদা আরো বলেন, ” প্রকৃতপক্ষে আমরা নক্ষত্রে মেরুপ্রভা দেখতে পাচ্ছি — এটিই এই বেতার নির্গমন কি, গ্রহের নিজস্ব বায়ুমণ্ডল থাকলে মেরুপ্রভাও থাকা উচিত ।” গবেষকরা মনে করেন যে, চৌম্বক ক্ষেত্রসহ একটি বহিঃসৌর পাথুরে গ্রহের জন্য ‘ওয়াইজেড সেটি বি’ গ্রহটি এখন পর্যন্ত দেখা সেরা প্রার্থী । জ্যাকি ভিলাডসেন বলেন, “এটি সত্যিই প্রশংসনীয়ভাবে হতে পারে । কিন্তু আমি মনে করি, একটি গ্রহের কারণে সৃষ্ট বেতার তরঙ্গের একটি সত্যিই শক্তিশালী নিশ্চিতকরণ বেরিয়ে আসার আগে এটি অনেক অনুপ্রেরিত কাজ (Follow-up) হতে চলেছে ।” এই দশকে সচল হওয়ার জন্য প্রস্তুত নতুন বেতার দূরবীক্ষণযন্ত্রগুলো জ্যোতির্বিজ্ঞানীদেরকে আরো বেশি সংকেত সনাক্তের সাহায্য করতে পারে যা চৌম্বক ক্ষেত্র প্রস্তাব করে । এক বিবৃতিতে ন্যাশনাল রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি অবজারভেটরির প্রোগ্রাম ডিরেক্টর জো পেস (Joe Pesce) বলেন, “অন্যান্য সৌরজগতে সম্ভাব্য বাসযোগ্য বা জীবন-ধারণকারী পাথুরে পৃথিবীর মতো বহিঃসৌর গ্রহে আসলেই চৌম্বক ক্ষেত্র আছে কি-না তা নির্ধারণ করতে জগতগুলোর অনুসন্ধান সক্ষম হওয়ার উপর আংশিকভাবে নির্ভর করে । এই গবেষণাটি দেখায় না যে এই বহিঃসৌর বিশেষ পাথুরে গ্রহের সম্ভবত একটি চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে কিন্তু আরো খুঁজে পেতে একটি প্রতিশ্রুতিশীল পদ্ধতি সরবরাহ বা শর্ত আরোপ করে ।”
* তথ্যসূত্র: https://edition.cnn.com/ (By Ashley Strickland),
https://www.ndtv.com/ https://www.sciencealert.com/ (By FIONA MACDONALD)

338500886 517698687243418 6220483796606893520 n

মুহাম্মদ আস্রাফুল আলম (সোহেল)

Leave a Reply