ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা’র জুস প্রোব (The European Space Agency’s Juice probe) মহাকাশযান গত শুক্রবার ১৪ই এপ্রিল ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব কাঁধে ফ্রেঞ্চ গায়ানার কৌরো (French Guiana, Kourou) এর উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে বৃহস্পতির চাঁদে এক যুগান্তকারী বিশেষকার্যের উদ্দেশে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় । যদিও এর আগের দিন বৃহস্পতিবার বজ্রপাতের হুমকি বা আশংকার কারণে উৎক্ষেপণ প্রচেষ্টা ২৪ ঘন্টা বিলম্বিত হয়েছিল ৷ মহাকাশযানটি বৃহস্পতির মহা লাল বিন্দু (Great Red Spot), দৃষ্টিনন্দন রঙিন চকচকে বিশাল মেরুপ্রভা (Polar Aurora), গ্রহটিকে ঘিরে গ্রহীয় বলয় এবং কিভাবে বৃহস্পতির শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র এই গ্যাস দৈত্যটির নিকটবর্তী চাঁদে নানা পরিস্থিতির আকার ধারণ করে তার রহস্যময় ঘটনাও উদঘাটন করতে চায় । ১.৪ বিলিয়ন পাউন্ডের Jupiter Icy Moons Explorer টি যুক্তরাজ্যের সময় দুপুর ১.১৪ পি.এম আরিয়ান ০৫ রকেটে (Ariane 5 rocket) চড়ে আকাশ পাড়ি দেয় । এতে করে বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীরা দৃশ্যত স্বস্তি পেয়েছেন কারণ অনুসন্ধানটি সৌরজগতে সবচেয়ে জটিল মিশনে যাত্রা শুরু করেছে । কোনো সমস্যা ছাড়াই পৃথিবী থেকে কয়েক মিলিয়ন মাইল দূরে বৃহস্পতির কাছাকাছি যেতে জুস মহাকাশযানটির সময় লাগবে প্রায় ০৮ বছর ৷ বৃহস্পতিতে এর পথ সরাসরি থেকে অনেক দূরে হবে । পৃথিবী এবং শুক্র গ্রহের চারপাশে একাধিক মাধ্যাকর্ষণ সহায়তার সাহায্যে এটিকে তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে । অর্থাৎ ২০৩১ খ্রিস্টাব্দে এটি বৃহস্পতির কাছাকাছি গন্তব্যে পৌঁছবে ৷ এর নাম জুস মিশন (Juice Mission) ৷ মহাকাশযানটি পৌঁছানোর পর ১০টি উন্নত যন্ত্র বা অনুচরবৃন্দ (Suite) সহ বৃহস্পতি এবং এর বরফের চাঁদগুলো পর্যবেক্ষণ বা জরিপ করবে । বিশেষ করে বৃহস্পতির মহা লাল বিন্দু (Great Red Spot) কেন সঙ্কুচিত হচ্ছে, বৃহস্পতির তৃতীয় বৃহত্তম চাঁদ আইও (Io) কেনইবা সৌরজগতে সবচেয়ে আগ্নেয়গিরিগতভাবে সক্রিয় দেহ এবং বৃহস্পতির মহাসাগর-বহনকারী চাঁদে জীবন আছে কি-না বা কখনো ছিল কি-না ইত্যাদি । জুস মহাকাশযান সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিণ করার সময় ৩৫টি উড়ান (Flyby) সম্পন্ন করবে । চাঁদেরাই প্রধান আকর্ষণ । বৃহস্পতির ৯২টি উপগ্রহ বা চাঁদের মধ্য থেকে ০৪টি গ্যালিলীয় চাঁদের ০৩টি চাঁদকে বিশেষভাবে জুস মহাকাশযান পরিদর্শন করবে ৷ চাঁদে প্রাণের অস্তিত্বের পাশাপাশি বাসযোগ্যতা নিয়ে মহাকাশযানটি তথ্য সরবরাহ করবে যা বিজ্ঞানীদের গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হবে ৷ সূর্য থেকে প্রায় অর্ধ বিলিয়ন মাইল দূরে থাকা হিমশীতল পরিস্থিতি সত্ত্বেও জুস প্রোব বৃহস্পতির ০৩টি চাঁদ যেমন: ইউরোপা (Europa), ক্যালিস্টো (Callisto) এবং গ্যানিমিড (Ganymede) কে পরিদর্শন করবে যা তাদের বরফ পৃষ্ঠের নীচে গভীর তরল জলের মহাসাগরকে আশ্রয় দেয়, যেখানে সামুদ্রিক জীবন থাকতে পারে । বৃহস্পতির হীমশীতল চাঁদে উপ-পৃষ্ঠের নোনা জলের সমুদ্র আবিষ্কার, জীবন বা প্রাণ এবং বাসযোগ্যতার লক্ষণগুলো অন্বেষণ করার জন্য সৌরজগতের স্থানগুলো তালিকার উপরে ঠেলে দিয়েছে । যদি হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট (Hydrothermal vent) – সারা পৃথিবীতে সমুদ্রের তলায় পাওয়া যায় – জোভিয়ান চাঁদে বিদ্যমান থাকে, তবে তারা অন্ধকারের মধ্যে জীবনের উন্নতির জন্য যথেষ্ট উষ্ণতা সরবরাহ করতে পারে । UCL Mullard Space Science Laboratory এর অধ্যাপক অ্যান্ড্রু কোটস (Prof Andrew Coates) বলেন, ”অবশেষে জুস মহাকাশযানটিকে তার পথে দেখে আমি খুবই রোমাঞ্চিত । বৃহস্পতির চাঁদে বাসযোগ্যতা দেখার জন্য এটি একটি দুর্দান্ত মিশন ।” অধ্যাপক অ্যান্ড্রু কোটস জুস প্রোবের উপর পেপ (Pep) এবং জানুস (Janus) নামক ০২টি যন্ত্র তৈরি করতে সহায়তা করেছেন । University of Leicester’s Institute for Space এর পরিচালক এবং জুস প্রোবের J-Mag magnetometer এর সহ-তদন্তকারী অধ্যাপক এমা বান্স (Prof Emma Bunce) বলেন, “এটি বৃহস্পতির একটি দীর্ঘ যাত্রার শুরু মাত্র, তবে এটি অপেক্ষা করার মতো হবে ৷ একটি অবিশ্বাস্য আন্তর্জাতিক দলকে এই মাইলফলকে পৌঁছতে অনেক বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে ।” রোবোটিক জুস মহাকাশযানটি বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপাতে (Europa) ০২টি উড়ান সম্পাদন করবে ৷ ইউরোপা চাঁদটি তার মূল গ্রহ বৃহস্পতির এতো কাছাকাছি থাকার কারণে তীব্র বিকিরণ ক্ষেত্রের অংশে মহাকাশযানটির পরিদর্শন সীমিত হবে । ইউরোপার আরো পর্যবেক্ষণ, যা শিখা (Plume) এবং উষ্ণপ্রস্রবণের (Geyser) মাধ্যমে আগ্নেয়গিরি মুখের জলীয় বাষ্পকে মহাকাশে প্রেরণ বা প্রবাহিত করে বলে মনে হয় । এদিকে নাসা (NASA) কক্ষপথ সমন্বিত বিকাশের একটি আন্তঃগ্রহের মিশন ইউরোপা ক্লিপার প্রোব (Europa Clipper probe) যা আগামী বছর অক্টোবরে SpaceX এর সবচেয়ে শক্তিশালী রকেটে উৎক্ষেপণ করবে । কিন্তু আরো সরাসরি যাত্রাপথ নিয়ে ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে জুস মহাকাশযানের আগে পৌঁছাবে । ধারণা করা হয়, শুধুমাত্র ইউরোপা চাঁদেই (Europa) জীবন আশ্রয়ের সম্ভাবনা রয়েছে । এটি মাত্র ২০০০ মাইল চওড়া এবং পৃথিবীর চাঁদের চেয়ে ছোট । তবে ১০০ মাইল পর্যন্ত গভীর মহাসাগরের সাথে, এটি পৃথিবীর সমস্ত মহাসাগরের চেয়ে দ্বিগুণ জল ধরে রাখতে পারে । ইউরোপা চাঁদটি বিশেষভাবে বাধ্যতামূলক লক্ষ্য কারণ এর মহাসাগর একটি পাথুরে সমুদ্রতলের উপর বসে বলে মনে করা হয়, যা জীবন্ত প্রাণীদের টিকিয়ে রাখতে পারে এমন থার্মাল ভেন্ট (Thermal vent) এবং পুষ্টির সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে । জুস মহাকাশযান ক্যালিস্টোতে (Callisto) ২১টি উড়ান সম্পাদন করবে ৷ এছাড়া বৃহস্পতির সর্ববৃহৎ ও একটি ভারী গর্তযুক্ত চাঁদ গ্যানিমিডে (Ganymede) ১২টি উড়ান সম্পাদন করবে ৷ গ্যানিমিড চাঁদ বুধের চেয়ে শতকরা ০৮ ভাগ বড় এবং সৌরজগতের বৃহত্তম ও একমাত্র চাঁদ যেটি নিজস্ব চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে । যখন জুস প্রোবটি ২০৩৪ খ্রিস্টাব্দে গ্যানিমিড চাঁদের চারপাশে কক্ষপথে ঘুরবে, তখন এটি আমাদের নিজস্ব চাঁদ ছাড়া অন্য কোনো একটি চাঁদকে প্রদক্ষিণ করবে । যখন জুস নিজেই জীবন সনাক্ত করতে সজ্জিত নয় – ছয় টন জুস প্রোবটি জলের পকেট বা জেব, জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান এবং শক্তির উৎসগুলো অনুসন্ধান করবে । গ্যাস দানব বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুন গ্রহ ০৪টিকে জোভিয়ান গ্রহ (Jovian planet ) বলে । জুস প্রোবটি জোভিয়ান চাঁদগুলোকে অতিক্রম করার সময় এটি তাদের ভূতত্ত্ব, কার্যকলাপ এবং পরিবেশের তথ্য সংগ্রহ করবে । ব্রিটিশ মহাকাশ পদার্থবিদ এবং লিসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Leicester) প্ল্যানেটারি প্লাজমা পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক এমা জে. বান্স (Emma J. Bunce) বলেন ”আমি আশা করি যে এই মিশনটি বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানী এবং অনুসন্ধানকারীদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে, ঠিক যেমন আমরা অনেকেই আজ মহাকাশ শিল্পে কাজ করছি যারা আগের মহাকাশ মিশনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি । বৃহস্পতি তন্ত্রে (Jupiter system) আমাদের সামনে একটি উত্তেজনাপূর্ণ ভবিষ্যত রয়েছে এবং আগামী বছরগুলোতে জুস মহাকাশযানের সমৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক তথ্য ফেরতের অপেক্ষায় আছি ।”
*তথ্যসূূত্র: https://www.theguardian.com/international (দি গার্ডিয়ান)
https://www.theguardian.com/science/2023/apr/14/juice-mission-blasts-off-to-jupiter-to-assess-lunar-habitability
মুহাম্মদ আস্রাফুল আলম (সোহেল)