এই যে এতগুলো বছর পেরিয়ে এলাম, পেরিয়েই এলাম, পার করলাম না। সেদিন সন্ধ্যায় বজরা নিয়ে গঙ্গায় যাত্রা শুরু করলাম। কেন করলাম? মন শান্ত করবো বলে। মনের বড় জ্বালা। তার শুধু নেই আর নেই। এটা নেই, ওটা নেই। শুধু নেই? তার সাথে যোগ দিয়েছে ‘কেন’ আর ‘না’। এটা কেন হচ্ছেনা? ওটা ওরম কেন হচ্ছে? প্রশ্নের হিমালয়। তাকে অতিক্রম করার জন্য কোনো তেনজিং ও ভূমিষ্ট হয়নি।
সেই মন নিয়েই যাত্রা করেছিলাম বজরায়। ভেবেছিলাম গভীর জলরাশি দেখে সে শান্ত হবে, বিশাল আকাশ দেখে অবাক হবে। কিন্তু সে শুধু বিষাদ কেই বড় করে দেখলো। অমাবস্যার রাতে মাঝ গঙ্গায় যেই একটু কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো, যেই ঝড় উঠলো, নৌকা দুললো, তার তখন চিল চিৎকার।
অথচ এতো দিন দুপারের সবুজ গাছ, হলুদচুড়া আর রাধাচুড়ার সারি, কোনো পাড়ে বাচ্ছা ছেলেদের জলে ঝাঁপ দিয়ে দাপাদাপি, কোনো ঘাটে কোমরে কলসী দুলিয়ে সদ্য বিবাহিত হওয়া নববধুর জল নিতে আসা, তার গুরু গম্ভীর নিতম্বের ছন্দ, সে ছন্দে কবি কালীদাসের সৃষ্টি করা কাব্য, তানসেনের বাঁধা ‘ভৈরবী’, তার স্তনের ভারে কাঁধ থেকে খসে যাওয়া জামদানী, কোমরের কলস আর স্তনের দুলুনী তে সৃষ্ট ‘পিলু’, সে সব সে দেখলোই না। যেন চোখদুটো তার কাজেই লাগে না।
বজরা সাজিয়েছিলাম ফুলের সুগন্ধে। তার কোনো ঘরে বেলিফুলের সুবাস, কোনো ঘরে গোলাপের। আর নিজেকে সাজিয়েছিলাম আতরের মূর্ছনায়। গায়ে সিল্ক্বের পাঞ্জাবি। তাতে সোনার জড়ির কাজ। মন দেখো সেই কালো মুখ করেই রয়ে গেল। যেন দাবানলের আঁচে পোড়া। এই যে এত সাজ, এত সুবাস, তার কিছুই চোখে পড়লনা। সেগুন কাঠের পালঙ্ক, মসলিনের চাদরেও তার ঘুম আসেনা। নাই বা আসলো, দুদণ্ড চোখ ত বুঁজুক। মনের যত জ্বালা। তার চোখে ঘুম কি? সে সর্বগ্রাসী চোখ দিয়ে শুধু চেয়ে থাকে। উপলব্ধি করেনা শুধুই গ্রাস করে। সে বুভুক্ষু। বজরার সৌন্দর্য সে গ্রাস করেছে এক লহমায়।
পূর্নিমার সৌন্দর্য্যে তো সবাই মোহ হয়। ভেবেছিলাম মনকে অমাবস্যার নিস্তব্ধতা দেখাবো। সেই নিস্তব্ধতায় মাঝনদীর জলের কলকল শব্দ, দাঁড়ের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ, আর আমার সেতারের ‘বেহাগ’ শোনাবো। সে ‘মুলতানী’ আর ‘সারং’ কেই সহোদর ভেবে বসল, তাকে আর বেহাগের যাত্রা কি বোঝাই। সে শুধু ‘নেই’ কেই আপন করে নিল। তার জন্য আমার এত বিনিদ্র রজনী চেয়ে দেখলোনা, ভৈরবীর সুরে আমার তন্দ্রা টাই তার কাছে খুনী হয়ে দাঁড়ালো।
✒️ নী লা ঞ্জ ন ||
১৩ই চৈত্র।
নীলাঞ্জন