আজ মহাসপ্তমী
– – – – – – – – – – – – –
মঙ্গলময়ী মা সকলের মঙ্গল করুন।
আমার মামা বাড়ি নন্দুয়াড়া (রঘুনাথপুর) সরাক পরিবারের মহা ধুমধামের সহিত বাসন্তী পূজো হয়ে আসছে আমাদের জন্মের বহু পূর্ব থেকেই। সম্ভবত আমার মামা দাদু স্বর্গীয় মাধব মাজী ১৯৬০ সালের আশপাশ থেকে শুরু করেছিলেন এই বাসন্তী পূজো। বংশানুক্রমে সেই পূজো হয়ে আসছে আজিও। হিসাবের নিরিখে পঞ্চাশ বছরের পুরাতন পূজো।
মেড় দেওয়া মূর্তি পূজোর অনেক দিন আগে থেকে বাড়িতেই তৈরি হয়। প্রথমে কাঠের কাঠামো তৈরি করে খড়ের ঠাট বাঁধা হয়। পরে পরে মাটির প্রলেপ দিয়ে ঠাকুরের আদল তৈরী হয়। তার মুখ ও আঙুল লাগানো হলে খড়ি মাটির এক মেট্যার ওপর রঙ চড়ানো হয়। এর পর বিভিন্ন পর্যায়ে রঙের কাজ শেষ করে ঘাম তেল মাখিয়ে ডাকের কাজ ও চক্ষুদান হলে মূর্তি গড়ার কাজ শেষ হয়। মন্দির রঙের পর পরিষ্কার করে নব মূর্তি বসানো হয়।
রুদ্র মূর্তি মা বান্তীর অসুরের দিকে তাকিয়ে তীরবিদ্ধ রত অবস্থায়। অসুর তার বাহুবলে প্রতিহত করতে চেষ্টায়রত। নীচে জিহ্বা কেড়ে শুয়ে থাকে অসহায় মোষ। তাকে খুবলে খায় মায়ের বাহন রূপী হিংস্র সিংহ ।
এই সমস্ত কাজ ছেলেবেলা থেকে খুব দেখে এসেছি।
ঐ দিকে বাড়ি হতে কয়েক শত গজ দূরের মন্দিরে ফি বছর ভিতর বাহিরে চুন দেওয়া ও জানালা দরজায় রঙ করানো হোত, এখনো হয়।
চুন আর রঙের গন্ধে মন্দিরে একটা পূজোর আমেজ খুঁজে পেতাম। পরে পরে মন্দির সংলগ্ন রাস্তায় ত্রিপাল টাঙানো হত। পাড়ার ছেলে মেয়েরা মহানন্দে আত্মাহারা হয়ে সকাল সন্ধ্যা খেলা ধুলায় মত্ত থাকতো। সকাল সন্ধ্যায় ঢাকের বাদ্যিতে পাড়া মুখরিত হোত।
না আমাদের মন্দিরে কোন ছাগ বলি হয় না।
ষষ্ঠীতে মায়ের আবাহন , সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে মহা পূজো ও দশমীতে হয় বিসর্জন ।
অষ্টমী ও নবমী পূজোয় জুড়ি বা ক্ষীর প্রসাদ বাহ্মণ নিজ হাতে পাক করতেন। সেই বিশেষ প্রসাদ খাওয়ার সময় আর আমাদের হাতে নেই। সেই প্রসাদ ও আশীর্বাদ ফুল বেল পাতা মা দিদিরা পাড়ার ঘরে ঘরে দিয়ে আসতেন।
এই পূজো উপলক্ষে আমার মা প্রতি বৎসর যেভাবেই হউক মামা বাড়িতে পৌঁছে যান। আমারা এখন আর মামা বাড়ির পূজোতে উপস্থিত থাকতে পারি না। দূর থেকেই মা কে প্রণাম জানাই। আমার স্ত্রী বেশ কয়েক বার ছেলে মেয়েকে নিয়ে পূজোর সময় মামা বাড়িতে থেকেছে।
মূর্তি বিসর্জন হলে পর অষ্টম দিনের আগে ঐ বিসর্জন হওয়া ঠাকুরের ঠাট আবার শুকিয়ে মন্দিরে রাখা হয়। এই ঠাকুর সারা বৎসর ধরে নিত্য পূজো পান।
বাসন্তী মাতার মন্দির টি মামা বাড়ি থেকে সামান্য দূরে বাগ্দী ও তাঁতি পাড়ায় অবস্থিত।
স্বর্গীয় নিরু ঠাকুর ও উনার মৃত্যুর পর ছেলে রামপ্রসাদ ও শম্পু পূজো করে আসছেন।
আগে আগে নবমীর দিন রাত্রে প্রায় শপাঁচেক ব্রাহ্মণ কুটুম্ব সেবা হোত।
দেবী মূর্তি তৈরী করে আসছেন বংশ পরম্পরায় বাজার পাড়ার স্বর্গীয় শিবু ছুতোর পরিবার।
পূজোতে অনেক উপাচারের মধ্যে ১০৮ টি পদ্ম ফুল ও অশোক ফুল নাহলে পাতা সমেত ডাল অবশ্যই লাগে।
আমার ফকির মামা এই ডাল আনতে আমাদের গদীবেড়ো গ্রামের বাড়িতে ফি বৎসর গিয়ে শ্রী শ্রী রামচন্দ্র আর্দশ বিদ্যালয় থেকে আনতেন। গাছটি আজিও স্ব মহিমায় রয়েছে ।
সেই মামা কে, মামা বাড়ির দাদু – দিদাদের আর এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ডোম বাদ্য বাজাতো মোড়্যা ডোম। অনেক সময় গদীবেড়ো থেকে রাখাল ঢোমের দল ভাসানের বাজনা বাজাতে যেতেন। রাখাল সেই দলের বাঁশি বাজিয়ে ছিলেন। মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বাঁশিতে ফুল দেওয়া যেন এখনো দেখতে পাচ্ছি।
সুখ – দুখঃ এর মধ্য দিয়ে বাসন্তী মা ফি বৎসর একক বাড়ির পূজো হিসেবে পূজো পেয়ে আসছেন। শুনেছি
মায়ের নামে কিছু জমি দেবত্তর করা আছে। তবে বর্তমান বাজার মূল্যে তা থেকে ধান্য বিক্রয় বাবদ যে মূল্য পাওয়া যায় তা যথেষ্ট হয় না।
আমি যখন নন্দুয়াড়া মামা বাড়িতে থাকতাম নিত্য পূজোর জন্য প্রত্যহ সকালে ফুল বেল পাতা তুলে আনতাম। পূজোর সময় রাত জেগে আনন্দ নিতাম।
পূজোর প্রসাদ হিসেবে আমার দিদারা আগের থেকে চিনির মণ্ডা, গুড়ের মিঠাই, বুঁদে তৈরি করিয়ে রাখতেন।
পাড়ার স্বর্গীয় মহাদেব দাদু পূজোর জোগাড়ে থাকতেন। বড়দা, মনগাঁ, পলমা, ভাগা বাঁধ, পাঁচপাহাড়ি ও অন্যান্য গ্রাম থেকে আত্মীয় স্বজন বাড়িতে আসতেন, এখনও আসেন।
বেল বরনের সময় শাঁক, ঢাক, ঝাঁঝ বা ঝারল বাজিয়ে কলাবোউ পূজো হয়ে দোলায় করে আনা হয় ও দশমীর রজনীতে চোখের জলে দেবী মূর্তি বিসর্জন করা হয় জয়চন্ডী পাহাড়ের পশ্চিমের কালি পাহাড়ের গোড়ার বুড়হার বাঁধে বা পুকুরে।শুনেছি বুড়হার বাঁধ সরাকদের নিজস্ব বাঁধ। কাদের তা জানি না।
এখন পূজোর দায়িত্ব পড়েছে আমার দুটো ছোট ভাই বিনয় মাজী (প্রনব) ও ফটিক মাজী এর ওপর। তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন সরাক, তন্তুবায় ও বাগ্দী পাড়ার সকল পরিবারগুলো।
আমার মামা বাড়িতে ছাড়াও উপর নন্দুয়াড়ায় ও লবাঁধির জটাধারী সাধু বাবার মন্দিরেও বাসন্তী পূজো দীর্ঘদিন হয়ে আসছে।
পথ নির্দেশ – রঘুনাথপুর নূতন বাস স্ট্যান্ড থেকে আদ্রা যেতে পড়ে নন্দুয়াড়া মোড়। সেখান থেকে সরাক পাড়ার পথে।
এবার আসি পৌরাণিক ব্যাক্ষায় – – –
– – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – –
চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের বাসন্তী পূজোই বাঙালীর আদি দুর্গা পূজো। যদিও এখন আশ্বিন শুক্লপক্ষের দুর্গো পূজোই বেশি আড়ম্বরে পূজিত হয়।
পূরাণ অনুযায়ী, সমাধি নামক বৈশের সঙ্গে মিলে
রাজা সুরত বসন্ত কালে ঋষি মেধসের আশ্রমে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। যা পরে বাসন্তী পূজো বলে প্রসিদ্ধ হয়। দেবী দুর্গার প্রথম পূজারী হিসাবে চণ্ডীতে রাজা সুরথের উল্লেখ রয়েছে।
সুরথ সুশাকও যোদ্ধা হিসেবে বেশ খ্যাত ছিলেন ।
কোন যুদ্ধে তিনি নাকি কখনো হারেননি। কিন্তু প্রতিবেশী রাজ্য একদিন তাকে আক্রমণ করে এবং সেই যুদ্ধে সুরথ পরাজিত হন। এই সুযোগে তার সভাসদরাও লুটপাট চালায়। কাছের মানুষের এমন আচরণে স্তম্ভিত হয়ে যান তিনি। বনে ঘুরতে ঘুরতে তিনি মেধাসাশ্রমে পৌঁছান।
ঋষি তাঁকে সেখানেই থাকতে বলেন। কিন্তু রাজা শান্তি পান না। এর মধ্যে একদিন তাঁর সমাধির সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জানতে পারেন, সমাধি কে তাঁর স্ত্রী এবং ছেলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। তবুও তিনি বৌ – ছেলের ভালো মন্দ এখনও ভেবে চলেছেন।
তাঁরা দুই জনেই তখন ভাবলেন, যাঁদের কারনে তাদের সব কিছু হারিয়েছে, তাদের ভালো আজও তারা চেয়ে যাচ্ছেন। ঋষিকে একথা বলায়, তিনি বলেন সবই মহামায়ার ইচ্ছা। এরপর ঋষি মহামায়ার কাহিনী বর্ণনা করেন। ঋষির উপদেশই রাজা কঠিন তপস্যা শুরু করেন।
প্রণাম মা
– – – – – – – –
বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল
গদীবেড়ো
বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল