You are currently viewing মা

মা

                               মা
                   দেবাশীষ চক্রবর্তী
    রাত এগারোটা নাগাদ স্টেশনে নামতেই হঠাৎ  লোডশেডিং হয়ে গেল। গা টা ছম ছম করে উঠল আমার, জায়গাটা শুনেছি ভাল নয়। এটা গর্জন শর্মার এলাকা। এখানে লুঠ-খুন, তোলাবাজি রোজকার ঘটনা। লোকে বলে, এই সাতপোড়া স্টেশনের পাশের ঝিলে ভূত আছে। অনেকেই মাঝরাতে ঝিলের মাঝখানে একটা বউকে বসে থাকতে দ্যাখে। ট্রেন থেকে আর যারা নেমেছিল সবাই উল্টোদিকে হাঁটা দিয়েছে। শুনশান, অন্ধকার এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে আমি একা।
   আজ জমিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। প্ল্যাটফর্মের সব দোকান বন্ধ। দুটো কুকুর বেঞ্চে শোয়া। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার; একটা লোকেরও চিহ্ন নেই। ভয়ে আরো বেশি শীত করছিল, তবু আমাকে এখান থেকে মিনিট দশ হেঁটে মধু বসুর বাড়ি যেতে হবে।
   আমি বিশ্বেশ্বরীকালী মন্দিরের ডেলিভারি ম্যান, অরুণ ভট্টাচার্য। অনলাইনে যারা পুজো দেয় তাদের বাড়ি মন্দিরের পঞ্চাশ কিলোমিটারের মধ্যে হলে, আমি তাদের বাড়িতে মায়ের প্রসাদ আর আশীর্বাদী ফুল পৌঁছে দিই।
মধুবাবুর ছেলে আজ কানাডা থেকে অনলাইনে তৎকাল পুজো দিয়েছেন। তাঁর শর্ত একটাই রাতেই মধুবাবুর কাছে প্রসাদ আর আশীর্বাদী ফুল পৌঁছে দিতে হবে। মধুবাবু অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে চেন্নাই যাবেন। ভোর পাঁচটায় তাঁরা বেরোবেন।
   আমার রাত নটায় এখানে পৌঁছোনোর কথা ছিল, কিন্তু কপাল খারাপ। সুখচরে রেল লাইনের উপর দুটো লরি খারাপ হয়ে পড়ে থাকায় ঘন্টা খানেক দেরি হল। তারপরে আবার পলতার কাছে এক স্থানীয় নেতা খুন হওয়ায় রেল অবরোধ। ব্যস পুরো দুঘন্টা দেরি তার উপর এই আচমকা লোডশেডিং।
একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা !
   মধুবাবুকে ফোন করলাম। ওঁরা জেগে আছেন। ওঁদের বিশ্বাস-ভরসার অমর্যাদা করা যায় না। মন্দিরের সুনামের ব্যাপারটাও আছে। সুতরাং ভয় পেলে চলবে না। রাস্তায় কুকুরতো থাকবেই, গর্জনের লোকও থাকতে পারে। দুতরফই আক্রমণ করতে পারে, তবু পথে নামতে হবে। তাছাড়া রাতটাও প্ল্যাটফর্মেই কাটবে। তাই ভয় পেলে চলবে না। আমার সঙ্গে অবশ্য প্রাণটা ছাড়া আর মূল্যবান কিছু নেই।
   বিদ্যুৎ তাড়াতাড়ি আসবে বলে মনে হল না। অন্ধকার একটু চোখ সওয়া হতেই জয় কালী বলে রাস্তায় নেমে পথনির্দেশ অনুযায়ী হাঁটতে শুরু করলাম। হাল্কা জ্যোৎস্না উঠেছে। কপাল ভাল, রাস্তায় একটাও কুকুর নেই।
  একটু এগোতেই একটা গুন্ডামার্কা ছেলে নিঃশব্দে সামনে এসে দাঁড়াল। কঠিন চাউনিতে ভয় ধরিয়ে বিশ্রীভাবে জিজ্ঞাসা করল, “এখানে নতুন?” ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম। আবার প্রশ্ন, “এত রাতে কোথায় যাচ্ছিস?”
   ভয়ে ভয়ে বললাম,’ মধু বসুর বাড়ি।” ছেলেটা সরে দাঁড়িয়ে  আমার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল। সাত-আট মিনিট হেঁটে  পুকুর পাড়ের হলুদ রঙের বাড়িটার সামনে এলাম। এমার্জেন্সি লাইট হাতে বারান্দায় একজন প্রৌঢ় দাঁড়িয়েছিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, “মধুবাবু?”
” হ্যাঁ,” বলে মধুবাবু কোলাপসেবল গেট খুললেন। ছেলেটা চলে গেল। প্রসাদ আর আশীর্বাদী ফুলের মোড়ক মধুবাবুকে দিয়ে বললাম, “চলি।” মধুবাবু অবাক হয়ে বললেন, “এত রাতে কোথায় যাবে? এখানেই থাকো, ভোরে আমাদের সঙ্গে যেও।”
  প্ল্যাটফর্মে থাকতে হবে ভেবে খুব আতঙ্ক হচ্ছিল। নিশ্চিন্ত হয়ে বললাম, “ঠিক আছে।” ভদ্রতাবশত জানতে চাইলাম , “মাসিমার কী হয়েছে?” ভদ্রলোক চাপা গলায় বললেন,” সেরিব্রাল অ্যাটাক, মাথার অপারেশন করাতেই চেন্নাই যাব।”
    কথাটা শেষ হতেই ঘরের থেকে মহিলা কন্ঠ ভেসে এল, ” সন্তু এলি?” মধুবাবু একটু ভেবে বললেন, “হ্যাঁ সন্তু এসেছে।” তারপর প্রায় ফিস ফিস করে বললেন, “তোমার গলা আমার ছেলে সন্তুর মতো। বয়সও হয়তো এক। একটা উপকার করবে?”
  বললাম, “নিশ্চয়।” মধুবাবু হাসলেন, “এই আশীর্বাদী ফুল  মঞ্জুর মাথায় ছুঁইয়ে দেবে চলো।”
   মধুবাবুর সঙ্গে ভিতরের ঘরে এলাম। আবছা আলোয় দেখলাম খাটে তন্দ্রাচ্ছন্ন মঞ্জুদেবী শুয়ে আছেন। কাছে গিয়ে বিশ্বেশ্বরীকালীর আশীর্বাদী জবাফুল তাঁর মাথায় ঠেকিয়ে কপালে ছোঁয়াতেই মঞ্জুদেবী আমার হাতটা ধরলেন। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই আনন্দে, জড়ানো গলায় বললেন, “সন্তু!” মৃদু স্বরে বললাম, “হ্যাঁ মা।” 

inbound4766675888549885263.jpg

দেবাশীষ চক্রবর্তী

Leave a Reply