inbound3740099391173636008
inbound3740099391173636008

মুঠো ভরা স্মৃতি

মুঠো ভরা স্মৃতি
(ছোট গল্প)
সুব্রত দত্ত
(শিলিগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)

অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সোফায় গা এলিয়ে সুস্নাত চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
—আঃ, কি শান্তি!
স্ত্রী শাশ্বতী অবাক হয়ে বলে,
—আজকের চা কি অন্যরকম হয়েছে?
—না, তা কেন? আসলে অফিসে বেশ কয়েকবার খেতে হলো সেই দুধ দেওয়া সিটিসি চা। তাই এই অর্থডক্স চায়ে চুমুক দিতেই মাথাটা হালকা হয়ে গেলো।
—সে তো রোজই খাও।
—হুঁ, তবে আজ মাথাটা ব্যথা করছিল। অফিসে কাজের চাপ ছিলো। একটা ভালো খবর অবশ্য আছে।
শাশ্বতী উৎসুক হয়ে পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,
—কি খবর গো! তোমাদের ডিএ বাড়ছে?
—ধ্যাৎ, দিলে তো মেজাজটা বিগড়ে! ঐ বকেয়া ডিএ ফিএ কিচ্ছু পাবো বলে মনে হয় না।
—তাহলে সুখবরটা কি?
দরজায় দাঁড়িয়ে টিকলির কান সেদিকেই।
—অফিস থেকে পিকনিকে যাওয়া হচ্ছে। ফ্যামিলি নিয়ে ২৫-শে ডিসেম্বর।
—টিকলি দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—বাবা সত্যি! ওঃ কি মজা হবে!
শাশ্বতী বলে,
—হুঁ, পড়াশুনা ছাড়া সব কিছুতেই তোমার মজা।
—দেখেছো বাবা, আমি পড়াশুনা করি না?
সুস্নাত মেয়েকে আদর করে বলে,
—মাকে জিজ্ঞেস করো, তাহলে 98 থেকে 100 পার্সেন্ট নম্বর আসে কোথা থেকে!
শাশ্বতী কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
—ঠিক আছে, আমি ওর পেছনে লেগে থাকবো না। দেখি কি করে অমন নম্বর পায়!
বাবার চোখের ইশারায় টিকলি এবার মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—ও মা, বলোনা, আমরা যাবো তো পিকনিকে? মা, প্লিজ। আমি পড়াটা মেকআপ করে নেবো।
—আমার কাছে এলি কেন? বাবাকে দিয়ে হলো না বুঝি!
—তোমার পারমিশন ছাড়া বাবা কোনও কাজ করে?
—কি বললি? দাঁড়া তো! আজ তোকে …( বলেই শাশ্বতী থাপ্পড় বাগিয়ে মেয়েকে তাড়া করে) যা, পড়তে বস আগে।
টিকলি দৌড়ে চলে যায় তার পড়ার ঘরে। মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে সুস্নাত বলে,
—বলে দিলেই পারতে মেয়েটাকে। কেমন মন খারাপ করে চলে গেলো!
—ডিনারের সময় বলে দেবো। কিছু চাইতে না চাইতেই যদি সব পেয়ে যায়, পরে চাহিদাগুলো আকাশ ছোঁয়া হয়ে যাবে।
—ও, ঠিক আছে, তুমি যা ভালো বুঝবে তাই করবে! হলো তো?
—হুঁ জানি তো, এসব বলি বলে আমি তোমাদের কাছে খারাপ।
—এবার তোমার অভিযোগের ফুলঝুরি নিভিয়ে দাও প্লীজ। খাওয়ার আগে আজকের কাগজটাতে একটু চোখ বুলিয়ে নিই। আর খবর পড়বো কি? সেই দুর্নীতি, ঘুষ দিয়ে চাকরি, টাকার পাহাড়, বুড়ো নেতার কচি বান্ধবী, সত্যি এসব আর ভাল্লাগে না।
—ধরাও তো পড়ছে।
—হ্যাঁ পড়ছে, ক’দিন বাদে হয়তো অব্যাহতিও পেয়ে যাবে! এর আগেও তো কত নেতাকে ধরলো। এখন দিব্যি ছাড়া পাখির মত উড়ে বেড়াচ্ছে, রাজনৈতিক দলের উচ্চ পদে বসে রয়েছে। আসলে বাংলার সংস্কৃতিটাই উচ্ছন্নে গেছে।
—তোমার “পাট্টি” কি করছে?
—গোড়ায় গলদ, বুঝলে গোড়ায় গলদ। জনগণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিপ্লব না ঘটিয়ে কয়েকটা রাজ্যে এই ব্যবস্থাপনায় ক্ষমতায় এসে কিছু সুরাহা করা যায়? জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব চাই। মানুষকে বোঝাতে হবে, সামগ্রিক উন্নতি চাই নাকি ভিক্ষেতেই তারা সন্তুষ্ট। সেটা আর হচ্ছে কই! দেখছোই তো, মঞ্চে মাতাল নেতা মন্ত্রীরা নাচনেওয়ালির সাথে নেচে নেচে টাকা ওড়ায়। অন্য রাজ্য থেকে আমদানি করা অপসংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। মানুষ এতেই মেতে রয়েছে। বাবুদের বাঈজী কালচারও এর চেয়ে ভালো ছিল। অন্ততঃ প্রকাশ্যে এসব হতো না।
—সত্যি, মেয়েটার ভবিষ্যৎ ভাবতেও ভয় লাগে। সরকারি চাকরি হবে বলে মনে হয় না।
—ওরকম চিন্তাই এনো না মনে। ওর হায়ার এডুকেশন বা চাকরির জন্য ভিন রাজ্যে এমনকি বিদেশেও যেতে হতে পারে।
—হ্যাঁ, বই দেখে অনলাইনে পরীক্ষা দিচ্ছে! এদের ভবিষ্যৎ কি?
—ঐ তোলাবাজ – মাফিয়া তৈরি হবে! না পারলে চপ, মুড়ি বিক্রি করে সংসার চালাবে!
—সত্যি, জেনারেশনের পর জেনারেশন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। বুদ্ধিজীবীরাও কেমন মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছে।
—ওসব ভাতাজীবীদের কথা ভেবে লাভ নেই। পারলে ইয়ং জেনারেশনই পারবে। (ঘড়ির দিকে তাকিয়ে) এই, সাড়ে ন’টা বেজে গেলো। এবার খেতে দাও।
ডিনারে শাশ্বতী খাবার পরিবেশন করতে করতে জিজ্ঞেস করে,
—কোথায় যাবে পিকনিকে?
—শিলিগুড়ির কাছাকাছি প্রচুর পিকনিক স্পট ছড়িয়ে রয়েছে। কাছাকাছি কালিঝোড়া আর দুধিয়ার মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে। আমার কোনটাতেই আপত্তি নেই।
টিকলি সাগ্রহে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,
—মা, আমরা যাবো না?
শাশ্বতী হেসে বলে,
—হ্যাঁ, আমরা তিনজনেই যাবো।
টিকলি আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলে,
—হে —–, কি আনন্দ!
—কিন্তু কথা রাখতে হবে।
—কথা?
—মেকআপ!
—মানে?
—সাজগোজের নয়, পড়াটা মেকআপ করতে হবে।
—ও হ্যাঁ, সে তো করবোই। মা, তিস্তা নদীতে স্নান করবো না?
—আজ্ঞে না। জল খুব ঠান্ডা। সর্দি লাগবে নির্ঘাত।
—জলে নামতেও দেবে না?
—তা কেন? অল্প জলে নামতে পারো।
—ওখানে বাঘ, হাতিও আসতে পারে, তাই না?
—হ্যাঁ, আসতেই পারে। তবে বাঁদর আসবে।
—তাই? ওদের জন্য কলা নিয়ে যাবো।
—বেশি বন্ধু হতে যেয়ো না। তোমার চশমা নিয়ে পালিয়ে যাবে।
—তাহলে তো মুশকিল!
—হুঁ, খাওয়া শেষ হয়েছে?
—হুঁ।
—যাও, এবার ঘরে যাও।
টিকলি হাতমুখ ধুয়ে তার ঘরে চলে যায়। শাশ্বতী সুস্নাতকে জিজ্ঞেস করে,
—তোমাদের শুভ্রাও যাবে তো?
—কে শুভ্রা?
—বাবা, এমন ভাব করছো যেন চেনো না! তোমাদের অফিসের।
—হ্যাঁ যাবে নিশ্চয়ই। সবাইকে বলা হয়েছে। তুমি অমন করে তাকিয়ে আছো কেন? “আমি” কিন্তু “ক্যাবলা হয়ে যাই”।
—ওরকম গায়ে পড়া মেয়ে আমি জীবনেও দেখি নি। একটু এড়িয়ে চলবে। লোকে ভালো চোখে দেখে না।
—দেখো শাশ্বতী, এই পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ রয়েছে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা জগৎ আছে। এ তো কোনও বই নয়, যে ইচ্ছেমত পাতা উল্টে পড়ে নেবো! তাই, মলাট দেখে যেমন বোঝা যায় না বইয়ের বিষয়, তেমনি বাইরে থেকে একটা মানুষের ভেটরটাও বোঝা যায় না। কথাটা মোটামুটি রবিঠাকুরের। আসলে কি জানো, শুভ্রা সবার সাথেই ফ্র্যাঙ্কলি মেশে। তবে তুমি যখন বলছো, তখন …
—তখন কি?
—ওভাবে তাকিয়ো না প্লিজ। সেই যে তোমাকে দেখতে গিয়েছিলাম, তুমি এমনি করেই আমাকে টেঁরিয়ে দেখছিলে। আমি তাতেই শরবিদ্ধ হয়ে গেলাম। এখনো ওরকম করে তাকিয়ে আছো? এটা কিন্তু একরকম আহ্বান জানানো। তাহলে কিন্তু …
—এই না! বুড়ো বয়সে ভীমরতি! টিকলি এসে পড়বে যখন তখন।
—আমি বুড়ো? তাহলে ঐ নেতারা কি?
—ওদের কথা ছাড়ো। প্রচুর ক্ষমতা ওদের।
—একটু …
শাশ্বতী বড় বড় চোখে তাকায়। সুস্নাত ভয়ের ভাব করে বলে,
—না, ঠিক আছে। কর্ত্রীর ইচ্ছেয় কর্ম! ধুস, পৃথিবীতে কেউ যেন বসের মেয়েকে বিয়ে না করে।
—কি? আমার বাবাকে টেনে আনলে?
—উঁহু মোটেই নয়। আমি আমার বসের কথা বলেছি।
—বেশি চালাকি না? (সোফার পেছনে দাঁড়িয়ে দু’গাল টিপে দিয়ে) এই গল্লু গল্লু গালগুলোকে না একদম মুচড়ে দেবো।
টিকলি ঘরে ঢুকতে গিয়ে হেসে বলে,
—একি বাবা, তোমার এই অবস্থা?
শাশ্বতী লজ্জ্বা পেয়ে বলে,
—এই, তুই এখানে কেন রে?
—একটা অঙ্ক পারছি না। এই যে খাতা। একটু বুঝিয়ে দাও না।
—এখানে কেন? তোর ঘরে যা। আমি আসছি।
এবার সুস্নাত তির্যক দৃষ্টি হেনে বলে,
—পাকা ড্রাইভারও তাহলে দুর্ঘটনা ঘটায়!
—বেশ করেছি। এবার থামবে?
—তুমি যখন বলছো থামতে, তখন …
—আবার!
সুস্নাত ইঙ্গিতে দু’ ঠোঁটের মাঝে তর্জনী ছুঁয়ে চুপ করে থাকার আশ্বাস দেয়। দু’জনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।
অবশেষে এলো সেই কাঙ্খিত ২৫-শে ডিসেম্বর। সুস্নাতরা সকাল সকাল স্নান সেরে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে কালিঝোড়া যাওয়ার ভাড়া করা দশটা গাড়ির একটিতে উঠে বসে। সিক্স সিটার দশটা গাড়ি ৫৮ জনের জন্য। একটা মালবাহী ছোট গাড়ি ক্যাটারারের জন্য। মোট এগারোটা গাড়ির একটা মিছিল এগিয়ে চলে। শালুগাড়া পেরিয়ে সবুজ অরণ্যের মাঝ দিয়ে কালো পিচের রাস্তা। শীতের সকালের হাল্কা কুয়াশার আস্তরণ এক মোহময় জগৎ সৃষ্টি করেছে। আগে বহুবার যাতায়াত করলেও প্রতিবারই এই রাস্তায় ভ্রমণ নতুনভাবে মনকে দুলিয়ে দেয়।
হঠাৎ সামনের গাড়ি থেমে যায়। তাই পরের গাড়িগুলোকেও থামতে হয়। কি ব্যাপার? সদলে গজরাজ শুঁড় দুলিয়ে পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছেন!
টিকলি তো ভয়ে অস্থির। কোনমতে মাকে বলে,
—এখন কি হবে মা?
—ভয় নেই। একটু পরে ওরা চলে যাবে।
একটা হাতি একটু এগিয়ে আসতেই গাড়িগুলোকে পিছিয়ে যেতে হয়। এবার শাশ্বতীও ভয় পেয়ে যায়। ভাগ্যিস হাতিটা বেশি দূর এগোয় নি! তাই রক্ষে। সবাই টু শব্দটি না করে অপেক্ষায় থাকে, কখন গজরাজ তাদের নিষ্কৃতি দিয়ে বনে চলে যায়। মিনিট কুড়ি পর রাস্তা ফাঁকা হলে গাড়িগুলো আবার চলতে শুরু করে। সবাই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রণাম করে। বন চিরে এগিয়ে চলে ওরা। কিছু দূর গিয়ে রাস্তাটা ঢালু হয়েই হঠাৎ উঁচু সেবক পাহাড়ের সামনে এসে পড়ে গাড়ি গুলো। ডান দিকে তিস্তা আর বাঁ দিকে সবুজ পাহাড়। মাঝে মাঝে গাছের ফাঁকে ফাঁকে শিলা পাথর উঁকি দিচ্ছে। তিস্তা এখন বর্ষার মত হিংস্র নয়। অনেকটাই শান্ত মেজাজে বয়ে চলেছে। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়িগুলো এঁকে বেঁকে সাপের মত এগিয়ে চলেছে। বাঁ দিকে পাহাড়ের গায়ে সেবকেশ্বরী কালী মন্দির। সবাই সেখানে প্রণাম করে আরো এগিয়ে চলে করোনেশন ব্রীজকে ডান হাতে রেখে। গাছে তো বটেই, নদীর ধারের রেলিঙেও অনেক দাঁত খিচানো বাঁদরের দেখা মিললো। টিকলি ভয়ে তার চশমা ব্যাগে ভরে নেয়। কিছুক্ষণ পরেই ঢাল বেয়ে নেমে তাদের গাড়ি এসে দাঁড়ায় তিস্তা নদীর ধারে। সবাই হৈ হৈ করে নেমে পড়ে। প্রথমেই চা – বিস্কুটের ব্যবস্থা করা হয়। ঘণ্টা খানেক পর ব্রেক ফাস্ট। লুচি, ছোট গোল আলুর দম আর মিষ্টি। পলিথিন শিট বিছিয়ে আড্ডা চলছে। অনেকেই এদিক ওদিক ঘুরে প্রকৃতির স্বাদ আকন্ঠ পান করছে। কেউ কেউ হাঁটু জল পেরিয়ে বড় বড় পাথরে বসে মাছ খুঁজে যাচ্ছে। আজ এখানে খুব বেশি পিকনিক পার্টি আসে নি। তাই ক্রিকেট খেলা সম্ভব হচ্ছে। ২২ জন বাচ্চা তো নেই। তাই তাদের আবদারে বড়রাও প্যান্ট গুটিয়ে খেলতে বাধ্য হয়েছেন। গিন্নিরা তাদের গল্পের হাঁড়ি খুলে বসেছে। পাশের পার্টি এসেছে মালবাজার থেকে। ওদের টিম বেশ বড়। তাদের সাথেও হাসি মস্করা চলছে। ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন রাজু সুস্নাতকে পাঠিয়েছে থার্ড ম্যান অঞ্চলে ফিল্ডিং করতে। নদীর পাশে। তাই বারে বারে জল থেকে বল তুলে আনতে হচ্ছে। বান্টির বলে পাপান এমন শট মেরেছে, বল সুস্নাতর মাথার ওপর দিয়ে ছক্কা। পাপানদের চিৎকার! রাজুর কপালে হাত! ওদিকে বল তিস্তার স্রোতে ভেসে চলেছে। সুস্নাত ছপ ছপ করে বলের পেছনে দৌঁড়চ্ছে। একটা বড় পাথরে লেগে বলের গতি কিছুটা কমেছে। পাথরে বসা এক ভদ্রমহিলা বলের দিকে হাত বাড়িয়েছে, আবার সুস্নাতও দৌঁড়তে গিয়ে টাল সামলাতে পারে না। দু’জনের ধাক্কা হাল্কা হলেও পিছল পাথরের কারণে দু’জন্যেই পড়ে যায় জলে। সুস্নাত তাড়াতাড়ি উঠে সেই ভদ্রমহিলার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। ভদ্রমহিলা ঘাড় ঘুড়িয়েই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলে ওঠেন,
—তুমি!
সুস্নাতেরও একই অবস্থা! সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলে,
—আমারও তো একই প্রশ্ন স্বাতী। তুমি এখানে কিভাবে?
ওদিকে রাজু অধৈর্য হয়ে চিৎকার করে উঠে,
—আঙ্কল, বলটা ছুঁড়ে দাও না। তারপর যত খুশি গল্প করো।
সুস্নাত রাজুকে বল ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
—ছিঃ! আমার জন্য ভিজে গেলে তো!
—তুমিও তো ভিজলে।
—না মানে, এই ঠাণ্ডার মধ্যে …
—পাশের পাথরটাতে বসে কাপড় শুকিয়ে নাও। তবে সেবার কিন্তু অনেক বেশি ঠাণ্ডা ছিলো। মনে আছে?
—ওরে বাবা, মনে নেই আবার! পাড়া থেকে লরি ভাড়া করে এই কালিঝোড়াতেই এসেছিলাম। দুই ডিগ্রি ছিলো টেম্পারেচার।
—তার ওপর আবার সেই বৃষ্টি! ত্রিপলের ছাউনিতে কি আর ওই বৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়া যায়? (হেসে) বাড়িতে খুব বকা খেয়েছিলাম, জ্বর হয়েছিলো বলে।
* * * * *
সুস্নাত আর স্বাতীর স্মৃতির মুঠো আলগা হয়ে যায়। ফিরে যায় সেই ২-রা জানুয়ারিতে। লরিতে কালিঝোড়ায় পৌঁছতেই বৃষ্টিটা ধরে বটে। কিন্তু সবাই ভেজা কাক হয়ে গেছে। সুস্নাত তার ভেজা জ্যাকেট একটা শুকনো ডালে শুকোতে দেয়। রান্নার জায়গার ওপরে ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে রাখা হয়েছে। বৃষ্টির ভয়ে। পাউরুটি, কলা আর ডিম সেদ্ধ সহযোগে ব্রেকফাস্ট সেরে নেয় ওরা। তারপর যে যার মত নদী আর পাহাড়ের অকাল বর্ষার রূপ-রস গন্ধ ও স্বাদ চেখে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কালিঝোড়া বাংলোর দিকে যায় সুস্নাত। বেশ সুন্দর! হঠাৎ পায়ের শব্দে পেছনে ফিরে স্বাতীকে দেখতে পায়। পাড়ায় দেখা হয়, কিন্তু সেভাবে কথা হয় নি কখনো। স্বাতী কথা শুরু করে,
—হ্যালো, তোমার নাম সুস্নাত না?
—হ্যাঁ, তোমার?
—স্বাতী গুহ। এখানে প্রথম এলে?
—হ্যাঁ।
—আমিও। (সিঁড়ি বেয়ে উঠে) বাংলোটা কি সুন্দর না?
—অবশ্যই সুন্দর। তাই তো এখানে “পাহাড়ি ফুল” ছবির শুটিং হয়েছে।
—কিন্তু ফিল্মের একটা জায়গায় এই বাংলোর জানালা খুলে কোন জায়গা দেখালো?
—হুঁ, কালিঝোড়ার জানালা দিয়ে মিরিকের লেক দেখা গেলো! এটাই তো সিনেমার কারসাজি। নাটকে এসব করা যায় না।
—তোমার নাটক আমি দেখেছি মিত্র সম্মিলনীতে।
—কোন নাটক?
—ওই যে তুমি এক বেকার ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছিলে! দারুণ মানিয়েছে তোমায়। আসলে তোমার চেহারায় একটা ইনোসেন্ট ভাব আছে।
—তোমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াতের সময় তোমার গান আমি মনে দিয়ে শুনি।
—কি যে বলো। সেভাবে শিখি না তো। মা জোর করেন, তাই করতে হয়।
সুস্নাত রেলিংয়ে ভর দিয়ে তিস্তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে স্বাতীর কথা শুনছিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে স্বাতীর সুগভীর চোখে চোখ রেখে বলে,
—না, আমি অযথা প্রশংসা করি না। তবে তোমার চোখ দেখে তোমার মনের কথা পড়ে নিতে পারি।
সুস্নাত-র চাউনিতে স্বাতী লজ্জ্বা পেয়ে বলে,
—অমন করে কি দেখছো?
—তোমায়!
—দেখার কিছু আছে?
—তাই? কিন্তু আমার মনে হয়, তোমার সৌন্দর্য্যের কাছে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ম্লান হয়ে যায়।
স্বাতী লজ্জ্বায় ওড়নায় মুখ ঢেকে বলে,
—এবার কিন্তু বাড়িয়ে বলছো।
—কেন, আর কেউ বলে নি?
—ধ্যাৎ, ভাল্লাগে না।
—নাঃ, অনেক ন্যাকামো করেছো। এবার চলো যাই। সবাই খোঁজ করবে।
—কি! আমি ন্যাকা?
—হুঁ, শর্মিলা ঠাকুরের মত।
—কি সব কথা!
—ঠিকই বলেছি। তবে ভালো লাগে। আমি তো মুনমুন সেনের মত বলি নি।
—তাই বলে আমাকে …
সিঁড়ি বেয়ে নামতেই ওরা দেখে পাড়ার কিছু ছেলে মেয়ে কলকল করতে করতে এগিয়ে আসছে। স্বাতী বলে ওঠে,
—এই রে! গীতা আমাদের দেখে ফেললো!
—তাতে কি হলো?
—ওরে বাবা, ওকে সবাই অল ইন্ডিয়া রেডিও নামে চেনে। কি যে বলে বেড়াবে কে জানে!
—বললে ক্ষতি কি? খারাপ কিছু করেছো কি?
একেবারে সম্মুখে এসে গীতা বলে,
—কিরে স্বাতী, কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি? আমরা তো খুব চিন্তা করছিলাম, তুই বাঘের মুখে পড়িস নি তো!
—ধ্যাৎ! এখানে বাঘ আসবে কোত্থেকে?
—(সুস্নাত-র দিকে চোখ রেখে) আসতেই পারে অন্য কোনো বেশ ধরে!
—ছাড় তো ওসব। চল।
—তোরা যা। আমরা বাংলোটা দেখে যাচ্ছি।
স্বাতী সবার সাথে গল্পে মেতে যায়। আর সুস্নাত রান্নার তদারকি করতে যায়। কাঠের উনুনে খাসির মাংস রান্না হচ্ছে। সুজিত তার ভেজা মোজা জোড়া কড়ার পাশে শুকিয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ একটা মোজা মাংসের কড়াতে পড়ে গেলো! রান্নার ঠাকুর তো রে রে করে উঠেছে। কি হবে এখন? সুজিত মোজাটা তুলে ঝোল সুদ্ধ কিছু মাংস ফেলে দেয়। সে বিষয়টা কাউকে বলতে বারণ করে। সুস্নাত-র মনে অশান্তি। চলে আসে আড্ডায়। একে একে অনেকেই গান শোনাচ্ছে খালি গলায়। এবার স্বাতীর পালা। সে বলে,
—হারমোনিয়াম ছাড়া!
সুস্নাত বলে,
—সবাই তো তাই করলো। তোমার আপত্তি কেন?
বাকিরাও সহমত জানালো। অগত্যা স্বাতী শুরু করে,
“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাই নি,
তোমায় দেখতে আমি পাই নি। …”
সবাই তার গানে চমৎকৃত!
এবার খাওয়ার সময় হলো। কলাপাতা আর মাটির খুঁড়ি নিয়ে লাইন দিয়ে বসে পড়ে সকলে। পাঁচজন পরিবেশন করবে। সুস্নাত সুযোগ বুঝে স্বাতীকে বলে,
—মাংস খেয়ো না।
—কেন?
—-(ইঙ্গিতে চুপ করতে বলে) পরে বলবো।
সুস্নাত আর স্বাতী দু’জনেই মাংস খেলো না বলে অনেকেই মুখ টিপে হাসছিলো। আর বৃষ্টি হয় নি বলে বাঁচোয়া। ফেরার পথে লরির ওপর আর ছাউনি দিতে হয় নি। তবে হাড় হিম করা ঠাণ্ডায় সকলেই কাবু হয়েছিলো।
তবুও দু’টি মনের এক হওয়ার আনন্দে উদ্বেল হয়েছিলো ওরা। কত রঙে রঙিন ছিলো দুটো বছর। কিন্তু হঠাৎ ওদের জীবনে ছন্দপতন ঘটে যায়। স্বাতীর বাবা বারাসতে বদলি হতেই ওরা শিলিগুড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। চিঠি আদান প্রদান হতো। সুস্নাত মাস্টার্স করে চাকরির খোঁজে। ধীরে ধীরে স্বাতী হারিয়ে যায় সুস্নাত-র জীবন থেকে। বাড়ির চাপে স্বাতী বিয়ে করতে বাধ্য হয়। শেষ চিঠিতে লিখেছিলো তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে। সুস্নাত
পারে নি তার সকরুণ আবেদনে সারা দিতে। তখন একটা কাজ পেলে সে নায়ক হতে পারতো। কিন্তু সে ভাবনা শেষ হয়ে যায়। শুধু মুঠো ভরা কিছু সুন্দর মুহূর্তের স্মৃতি রয়ে যায়।
* * * * *
টিকলির ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায় সুস্নাত।
—বাবা, এসো। খেতে ডাকছে।
—হ্যাঁ আসছি। জামা প্যান্ট ভিজে গিয়েছিলো, তাই শুকোচ্ছি।
—এবার এসো। মা ডাকছে।
—এইতো আসছি।
স্বাতী জিজ্ঞেস করে,
—তোমার মেয়ে?
—হ্যাঁ, ক্লাস টুয়েলভ। তোমার?
—কি মিষ্টি মেয়ে! আমার এক ছেলে। কলকাতায় পড়ছে, আই টি।
—ঠিক আছে, আজ উঠি তাহলে!
—যাবে? অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া হলো না যে!
—(হেসে) কিছু উত্তর না পাওয়াই থাক! প্রশ্ন ছাড়া জীবনের কোনো মানে হয় কি?
—ফোনে যদি …
—কি লাভ! ফিরে গিয়ে দু’জনেই নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বো। তাছাড়া, কথা বললেই পুরোন সবকিছু আবার ফিরে আসবে। তখন হয়তো একটা অধিকারের বৃত্তে আমরা আবর্তিত হবো। তার ফল ভুগবে দু’টো ফ্যামিলি। সেটা কি ঠিক হবে?
স্বাতী এক বুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
—হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। আসলে আমি একটু বেশি আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। ভালো থেকো।
—হুঁ, তুমিও স্বামী পুত্র নিয়ে ভালো থেকো। স্মৃতিগুলো মুঠোয় ভরে রেখো। আসি। Bye.
—Bye.
টিকলির ডাক শোনা যায়,
—ও বাবা, খেতে দিয়েছে তো।
—এই যে আসছি। তোরা শুরু করে দে।
সুস্নাত শেষে একবার স্বাতীকে দেখে নিয়ে জল পেরিয়ে চলে যায়। সুস্নাত-র বিদায়ে স্বাতীর চোখের জল গড়িয়ে তিস্তার জলের স্রোতে হারিয়ে যায়, যে তিস্তার পারে সে সুস্নাতকে একদিন মনের মানুষ হিসেবে পেয়েছিলো। সুস্নাত-র কথাই ঠিক। স্মৃতিসুধা মুঠোয় ভরা থাক।

inbound3740099391173636008

SUBRATA DUTTA

Leave a Reply