রুকুন খান

রুকুন খান 

স্মৃতিচারণ

রুকুন কথা 

তৈমুর খান

“—একটা চা দাও তো!

—তোমাকে চা দেবো না, অনেকবারই তোমাকে বাকিতে যা দিয়েছি, কিন্তু পরিশোধ করতে পারোনি।

—কখন তোমার চায়ের দাম দেইনি? হয়তো দু চার দিন দেরি হয়েছে। তাই বলে কি পয়সা মেরেছি?

—চা কি কেউ বাকিতে খায় রোজ?

—আজ বাকিতে  খাব তোমাকে কে বলল?

—তুমি পয়সা পাবে কোথায়? তোমার যা হাল তার সবই জানি!

—এই দেখো আমার টাকা! আজ তোমাকে চায়ের দাম নগদেই দিতাম! আজ আমাকে অপমান করলে!

—এসো এসো, চা খেয়ে যাও!

—আজ আর তোমার চা খাব না! চললাম…”

এই কথা কয়টিই ছিল আমার ছোট ভাই রুকুনের সঙ্গে চায়ের দোকানির শেষ সংলাপ। ঈদ উপলক্ষে দিন পাঁচেক আগেই ২০০০ টাকা দিয়ে পাঠিয়েছিলাম কিছু কেনাকাটার জন্য।সেই টাকা কয়টি পেয়ে ভারি খুশি হয়েছিল। ভাইজি ভাইপো ও তার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে রামপুরহাটের উত্তর দিকে সম্প্রতি গড়ে ওঠা নিউ টাউন ঘুরতে গেছিল। গ্রাম থেকে মাত্র দুই কিমির রাস্তা। আর সেখান থেকে ফেরার সময় চায়ের দোকানে চা খাবার জন্য দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সেদিন আর চা খাওয়া হয়নি। চায়ের দোকানদার জানত তার অভাবের সংসারে অকুলান বেশি। তাই সর্বদা হাত ফাঁকাই থাকত। নিজের অভাব থাকলেও কখনো সে অন্যকে জানাত না। আমার ছোট ভাই হওয়া সত্ত্বেও ঘুণাক্ষরেও আমার কাছে কখনো এক পয়সাও চাইত না। নিজে ইচ্ছে করে কিছু দিলে তবেই নিত। গ্রাম ছেড়ে চলে আসার পর আমার সঙ্গে যোগাযোগ খুব কমই হতো। চাক্ষুষ দেখা সাক্ষাৎ হতো না। ফোন করলে তাকে পেতাম না। বাড়িতে ফোন থাকলেও নিজের কাছে রাখতো না। পারিবারিক কী চাপা অশান্তি ছিল তা কাউকেই জানাত না। শুধু চোখের দৃষ্টিতে তীব্র উদাসীনতা লক্ষ করতাম। সংসারের মায়া-মোহ থেকে নিজেকে মনে হতো বিচ্ছিন্ন করছে। কিন্তু অনেক সময়ই তা সঠিক বলেও মনে হতো না। গ্রামের বাড়িতে গেলে দেখতাম ছাদের উপরে টবে নানা রকম সবজি চাষ করেছে। বেগুন শশা ঝিঙে আরো কত কী। রোজ বিকেলবেলায় সেগুলোতে সেচ দিত। সকালবেলায় দুটি ছাগলের জন্য পাকুড় গাছের পাতা ভেঙে আনত। নিজের ছেলেকে ডেকে নিজেই পড়াত। আত্মীয়-স্বজন, দূরের ও গাছের কুটুমদের রাস্তাঘাটে দেখা হলে ঘরে আসার জন্য আকুতি করত। কৃষি সমবায় উন্নয়ন নামে ব্যাংকে দিনের অধিকাংশ সময়ই কাটত তার। অনেক ব্যস্ত মানুষই ভাউচার লিখে সই করে দিয়ে তার কাছে জমা রেখে যেত। তাদের সেইসব পাসবই টাকাসহ নিজে গিয়ে তাদের বাড়িতে দিয়ে আসত। গ্রামের ছোটবড় কারো সঙ্গেই কখনো তার বচসা হয়নি। জোরে কথাবার্তা বলেছে এরকমও কোনো ইতিহাস নেই। মৃত্যুর দিনে গ্রামের সমস্ত লোকই এসে তাকে দেখে দু ফোঁটা চোখের জল ফেলেনি এমনটা হয়নি। 

  মৃত্যুর দিনে সকালবেলা সেই দিনই তাকে শেষ বকাবকি করেছিলাম। জানতে পেরেছিলাম বেশ কিছুদিন থেকেই সে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। শুধু একটা কথাই আমাকে বলেছিল ‘যন্ত্রণা ভোলার জন্য নেশা করি’। কিসের যন্ত্রণা? তা সে জানায়নি। যদি তা আগে থেকেও জানতে পারতাম তাহলে যে কোনো উপায়ে তার সমাধান করার ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা আর সম্ভব হয়নি। লিভার ক্যান্সার এতটাই মারাত্মক হয়ে উঠেছিল যে কোনোমতেই আর ফিরে আসার সম্ভাবনা ছিল না। 

১৯৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেছিল আমার ছোট ভাই তথা আমাদের বাড়ির সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান রুকুন খান। ৩৫ বছর পূর্ণ না করেই জীবনমঞ্চ থেকে তার প্রস্থান অবধারিত হয়ে উঠল। মৃত্যুকালে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হয়েছিল। বারবার ডেকেছিল ডাক্তারকেও। আর চোখ দিয়ে বেশ কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল। সেই মৃত্যু দৃশ্যটা কারো পক্ষেই দেখা সম্ভব হয়নি। সব মানুষের পরিণতি একই রকম হলেও বড়োর সামনে যখন ছোটোর মৃত্যু হয় তখন তার উপলব্ধিটাও মারাত্মক হয় তা আমি প্রথম অনুভব করেছিলাম। স্বজন হারানোর বেদনা তিল তিল করে কষ্ট দিতে থাকে। তার উপশম খোঁজাও বৃথা। এখন আমার থেকে ছোট পথে-ঘাটে যাদেরই দেখতে পাই তাদের সকলকেই আমার ভাইয়ের মতো মনে হয়। তাদের মুখে ওই ভাইয়ের করুন অসহায় মুখটি বসিয়ে দিই আর মনে মনে ভালবাসতে থাকি। এই অনন্তের শূন্যতায় কোথাও সেই আত্মা বিরাজ করলে তার জন্য শুভকামনা পাঠাই। 

কবি তৈমুর খান

Leave a Reply