সাঁড়াশি
দেবাশীষ চক্রবর্তী
এপ্রিল ফুল করা রতনবাবুর পুরনো অভ্যাস। চেনাশোনা সকলেই এই দিনটাতে তাঁকে এড়িয়ে চলে। তাই তাঁর ফোনটা পাত্তা দিল না মন্মথ। ফোনটা বেজে বেজে থেমে গেল।
গত বছর পয়লা এপ্রিল মন্মথ টিচার্স রুমে বসেছিল, হঠাৎ রতনবাবু ফোন করে বললেন, “মন্মথ ‘বঙ্গরস’এ তোমার কবিতা বেরিয়েছে। কবে খাওয়াবে?” মন্মথ বাংলার বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা ‘বঙ্গরস’ এ কবিতা পাঠিয়েছিল, তাই কথাটা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলশ, “দারুণ খবর! নিশ্চয় খাওয়াব।”
পাশেই ইতিহাসের শিক্ষিকা সুদীপা ছিল, কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল, “কী খবর মানুদা?” কবি খ্যাতি প্রত্যাশী মন্মথ আত্মতৃপ্তির সঙ্গে বলল, “এ মাসের ‘বঙ্গরস’এ আমার কবিতা বেরিয়েছে।” সুদীপা লাফিয়ে উঠল,” দাদা, তুমি তো বিখ্যাত কবি হয়ে গেলে, আজ খাওয়াতেই হবে!”
ব্যস সারা স্কুলে রটে গেল— মানুদার কবিতা ‘বঙ্গরস’এ বেরিয়েছে; আজ সবাইকে খাওয়াবে। মন্মথ হাসি মুখেই হাজার টাকা খরচ করে বাইশজনকে চিকেন রোল আর কফি খাইয়েছিল।
ছুটির পর মন্মথ ‘বঙ্গরস’ এর এপ্রিল সংখ্যা কিনে একরাশ আনন্দ আর উত্তেজনা নিয়ে সূচিপত্রে চোখ বোলাতে শুরু করল। তিন-তিনবার চোখ বুলিয়েও নিজের নামটা দেখতে পেল না। লজ্জায়, অপমানে তার মুখচোখ লাল হয়ে গেল। রেগেমেগে রতনবাবুকে ফোন করতেই তিনি হাসিতে ফেটে পড়লেন,”কেমন এপ্রিল ফুল করলাম!”
এরপর তিনমাস সে রতনবাবুর সঙ্গে কথা বলেনি। তারপর কথা আবার শুরু হলেও, মন্মথের রাগ এখনও যায়নি। আজ পয়লা এপ্রিল, রতনবাবু আবার ফোন করছেন। সে ফোনটা বোবা করে ক্লাসে চলে গেল। বেরিয়ে দেখে রতনবাবু ন’বার ফোন করেছেন।
কাউকে এপ্রিল ফুল করতে কেউ এতবার ফোন করে? নিশ্চয় অন্য কোনো ব্যাপার। সে রতনবাবুকে ফোন করে কড়া গলায় বলল, ” ব্যাপার কী? আবার বোকা বানাবেন?”
— আরে না, আমি নিজেই বোকা বনে গেছি।
— মানে?
— আর বোলো না এতদিন জানতাম আমার রাশি তুলা। এবছর তুলারাশির লটারিতে প্রাপ্তি যোগ আছে।
— তো?
— লোভে পড়ে তিনমাসে ছ’হাজার টাকার লটারির টিকিট কিনেছি, কিন্তু একটাকাও পাইনি। গতকাল আমার গুরু আদিত্যানন্দবাবা আমার বাড়িতে এসেছেন তিনি আমার ছক বিচার করতে গিয়ে দেখেন সব ভুল। আমার রাশি তুলা নয় বৃশ্চিক। এবছর বৃশ্চিকের অর্থ ক্ষয় হবে। ব্যাপারটা বুঝলে?
সব শুনে মন্মথ একটু খুশিই হল। গতবার তাকে কী লজ্জায় না পড়তে হয়েছিল, সঙ্গে ফালতু হাজার টাকা খরচ তো ছিলই, কিন্তু সে খুশি লুকিয়ে বলল, ” ফালতু ছ’হাজার গচ্চা গেল তো!”
— গেল তো, একেই বলে কপাল খারাপ। যাইহোক শোনো গুরুদেব আমার এখানেই আছেন, কাল যাবেন। ছেলের রেজাল্ট নিয়ে দুশ্চিন্তা করছ তো! গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করে যাও। ফল আগাম জেনে যাবে।
— ঠিক আছে ছ’টা নাগাদ যাব।
— কিছু ফুল, বেলপাতা আর তুলসিপাতা এনো। গুরুদেব ওতেই খুশি। অন্য কিছু আনবে না।
কথা শেষ করে সে আবার ক্লাস নিতে গেল।
মন্মথ ছুটির পর গাঁদারমালা, কুচোফুল, বেলপাতা আর তুলসিপাতা কিনে রতনবাবুর বাড়ি গেল।
দরজা খুলেই রতনবাবুর স্ত্রী ঝুমাবউদি জিজ্ঞাসা করলেন, ” ফুল এনেছ?” ফুলের প্যাকেটটা তাঁকে দিয়ে মন্মথ বলল, “আদিত্যবাবাকে এটা দেবেন।”
“আদিত্যবাবা!’ ঝুমাবউদি আকাশ থেকে পড়লেন,” সে কে ?”
— রতনবাবুর গুরুদেব।
— ওর আবার গুরুদেব! ও কিছু মানে?
— রতনবাবু কোথায়?
— বন্ধুর বাড়ি। আজ বৃহস্পতিবার, লক্ষ্মী পুজোর জন্যে ওকে এগারোটার সময় ফুল আনতে পাঠিয়েছিলাম আর ও সূর্যের বাড়ি চলে গেল; ফিরতে নাকি রাত হবে। একটু আগে ফোনে জানাল, মানু ফুল নিয়ে যাচ্ছে।
মন্মথ স্বুঝল সে আবার ঠকেছে, কিন্তু কিছু বুঝতে না দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “বউদি, রতনবাবুর কী রাশি ?”
ঝুমাবউদি মুুখ ঝামটা দিলেন, ” কী আবার জ্বালানি রাশি—সাঁড়াশি!”
দেবাশীষ চক্রবর্তী