সুকুমার হালদার

সুকুমার হালদার

কাব্য রিভিউ

আত্মসত্তার কাছেই খুঁজে পেয়েছেন আত্মসত্য

🍁

তৈমুর খান 

🍁

কবিতা লেখার তাগিদ তখনই অনুভূত হয় যখন নিজের মধ্যে নিজেকেই আবিষ্কার করার প্রচেষ্টা সক্রিয় হয়ে ওঠে।  নিজেকে আবিষ্কার করা সবচেয়ে কঠিন কাজ, কেননা কবির সততা, পক্ষপাতহীনতা এবং ছলনাহীনতা প্রয়োজন হয়। শুধু ভাষা আর প্রকরণে কবিতা সাজানোর যুগ মনে হয় শেষ হয়ে গেছে। তাই কবিরা আত্মগত পর্যটনেই সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম অভিযাপনকে তুলে আনেন। আত্মরসায়নের সেইসব শূন্যতা, বিপন্নতার দ্রবণের সঙ্গে অবদমন ক্রিয়ার নানা বাঁকগুলিও ইঙ্গিতে আভাসে লিপিবদ্ধ করেন। অনেক সময়ই তা জটিল কুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্টতায় লীন হয়ে থাকে। অনেক সময় তা না-বলার শূন্যতায় অপ্রকাশ্য থেকে যায়। আবার অনেক সময় তা প্রসঙ্গচ্যুতির নামান্তর হয়ে নাথিংনেসকেই নির্দেশ করে। 

  সুকুমার হালদারের তৃতীয় কাব্য 

‘ঈশ্বর ঘুমিয়ে গেছে’ (জানুয়ারি ২০২৩) পাঠ করতে গিয়ে এই কথাগুলিই মনে হল। মোট ৫৪ টি কবিতা নিয়ে ছিমছাম কাব্যগ্রন্থটি সহজ সরল ভাব-ব্যঞ্জকের আত্মস্বর হয়ে উঠেছে। যেখানে কবি নিজের ছায়ার পাশেই নিজেই দাঁড়িয়েছেন আর নিজেকেই দেখেছেন কখনো বাউল হয়ে, কখনো প্রেমিক হয়ে, কখনো অতি সাধারণ মানুষ হয়ে। তাই কবির হাতে উঠে এসেছে আয়না। ভাষাতেও আয়না, দেখাতেও আয়না, ইচ্ছাতেও আয়না। গৃহপালিত চাঁদ হয়ে সেই আয়নাকেই দেখেছেন। কেমন সেই আয়না? কবি নিজেই জানিয়েছেন:

“আয়নার ভিতরে আয়না

তার ভিতরে আয়না

মুখের ভিতরে মুখ

তার ভিতরে মুখ”

যখন এক একটি অঙ্গ এক একটি দর্শনের আয়না হয়ে ওঠে, তখন তার ভেতরেরও ছবি ভেসে ওঠে। কেমন সেই ছবি? কবি নিজেই জানিয়েছেন:

“ভুলের ভিতর ভুল

 তার ভিতরে ভুল

কৃষ্ণপক্ষে ঘর ভরে ওঠে!”

    কিন্তু তখন কেমন প্রতিক্রিয়া হয়? কবি আবারও জানিয়ে দেন:

“আয়নায় আটকে থাকে

পদচারণার শেষ রেশ

অস্তমিত আলো।”

   কিন্তু তখন তো অন্ধকার। প্রাচীন আসক্তির অন্ধকারে কবিকে টানতে থাকে। ধ্বংসপ্রাপ্ত অতীত আর শূন্যতার সামনে দাঁড় করায়। আয়না শুধু ছবির মাহাত্ম্য তুলে আনে না, জীবন ও প্রবৃত্তির, ক্ষয় ও ধ্বংসের, মৃত্যু ও জন্মের, আত্মদর্শনের যাবতীয় প্রজ্ঞাকে তুলে ধরে। তখন গৃহপালিত চাঁদ হয়েই শূন্যের বারান্দা আলোকিত করেন। তাকেই কবি বলেছেন ‘বিবর্ণ শূন্যতা’।ব্রিটিশ আমেরিকান কবি ডব্লুএইচ অডেন (১৯০৭-৭৩) বলেছেন: “Every man carries with him through life a mirror, as unique and impossible to get rid of as his shadow.”

(W.H. Auden, The Dyer’s Hand and Other Essays)

অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ তার সাথে জীবনের মাধ্যমে একটি আয়না বহন করে, তার ছায়ার মতো অনন্য এবং অসম্ভব। এই অনন্য এবং অসম্ভব আয়নার মধ্য দিয়েই কবি নিজেকে প্রতিফলিত করেছেন। সেখানে ঘুমিয়ে যাওয়া ঈশ্বর যেমন দেখা দিয়েছে, তেমনি প্রার্থিত সূর্যের অপেক্ষাও দীর্ঘ হয়েছে। কখনো খিদের আলোয় বাউলের আলখাল্লায় নাচের সমারোহ চলেছে। ভাত-ভাতারের কান্না থেকে অসুখের ইশতেহার এবং অনুর্বর চিৎকারও উঠে এসেছে।

আত্মবীক্ষার বিভিন্ন স্তর থেকে এক বিষণ্ণ পাঠ

সমগ্র কাব্যেই মর্মরিত। জীবন যে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চেয়েছে সেখানে আছে এক ধুধু মাঠ। দীর্ঘ এই পথের অনিশ্চিত জীবনযাত্রায় কবি ‘শূন্যতার সামনে দাঁড়াই’ বলেই মৃত্যুর প্রাচীনতাকে স্মরণ করেছেন। অসীমের ক্ষেত্রে ইতস্তত অস্পষ্ট বখাটে হাওয়ায় নিজেকে দেখতে গিয়ে আদিমতার কাছেই ধরা দিয়েছেন। পৃথিবীর আদি উৎসের সত্তায় নিজেকে আবিষ্কার করেছেন। তাই সবুজ ছড়ানো দেহের স্পর্শ উপলব্ধি করেই নিজেকে ‘ক্লোরোফিলের দেবতা’ মনে হয়েছে। অতীতকে না ভোলার অঙ্গীকার থেকেই নিজের মুখোমুখি হয়েছেন আর তখনই বলেছেন:

“এবার নিজের শরীরের চৌকাঠ পেরিয়ে

তার পায়ে পায়ে এগোলাম

নগ্ন পায়ের ছাপগুলো মিলনরেখা হয়ে প্রাচীনে

যেমন সব চলমান পা প্রাচীন হয়

প্রদীপ ও রাত্রির মতো নিকট হয়ে ঝুঁকে পড়লাম মুখোমুখি!

তুমি! সেই তুমি!

যার পায়ে পায়ে হাঁটার ঢেউয়ে চুরমার হয়েছিলাম!

আর দুদিকে ছিটকে গেছিল মঙ্গলঘট আমপাতা।”

আত্মসত্তার কাছে এই আত্মসত্য খুঁজে পেয়েছেন। সত্তার ‘দুই তুমি’-তে শুরু হয়েছে সংলাপ। নিঃসীম আত্মচেতনার বিষয় বলেই ‘অতল আমি ডুবে আছি তোমার তারায় তারায়’ বলে নিজের ব্যাপ্তি ও বিস্তারকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। অদ্ভুত নীরবতা থেকে ফেলে আসা ছায়াপথে পুরানো হাওয়ায় আত্মা-শরীরের উত্থান উপলব্ধি করেছেন। জন্মলিপিও কর্মলিপি হয়ে উঠেছে। নিজের ভেতর বৃক্ষপ্রবৃত্তিরও জাগরণ টের পেয়েছেন। অঙ্কুরোদ্গমের শিহরন জাগিয়ে তুলেছে বৃষ্টি, মাটি ও সূর্যের তাপ।

  কল্পনাগুলি খুবই আত্মগত নষ্ট ও বিষণ্ন, চাঁদের মৃত্যু, শীতের আগমন ও কম্পন, বেঁচে থেকেও বেঁচেথাকাকে  অবিশ্বাস (আমরা কি বেঁচে আছি?), আত্মহত্যা প্রবণ জীবনের অস্থিরতা , অন্ধকারে ডুবে যাওয়া আগামীর পথ, জীবনানন্দের দেখা সেই অবক্ষয় যুগের ‘উটের গ্রীবার মতো নীরবতা’ এই যুগেও ফিরে এসেছে। গান্ধী বা মার্কস,দেরিদা বা ফুকো কেহই সংশোধন করতে পারবে না।তাই কবি বলেছেন এই সময়ের ক্ষত সারাবার নয়। ‘প্রত্যেকটা রাত শূন্যতায় কাটে’। যুগের এই সীমাহীন মূল্যবোধহীনতাকে নিজস্ব আয়নাতেই প্রতিফলিত হতে দেখেছেন। কবি নিজেই হয়েছেন সময়ের বরপুত্র। 

ফরাসি কবি ও প্রবন্ধকার এবং শিল্প সাহিত্যের সমালোচক চার্লস পিয়েরে বাউডেলেয়ার (১৮২১-৬৭) একটি কবিতায় লিখেছেন:

“The Devil pulls the strings which make us dance;

We find delight in the most loathsome things;

Some furtherance of Hell each new day brings,

And yet we feel no horror in that rank advance.”

অর্থাৎ  শয়তান স্ট্রিং টানে যা আমাদের নাচতে বাধ্য করে;

আমরা সবচেয়ে ঘৃণ্য জিনিসগুলিতে আনন্দ পাই;

প্রতিটি নতুন দিন জাহান্নামের কিছু অগ্রগতি নিয়ে আসে,

এবং তবুও আমরা সেই পদে অগ্রসর হওয়ার কোনও আতঙ্ক অনুভব করি না।

   অবক্ষয় কতখানি আমাদের গ্রাস করেছে তা বুঝতে পারি। মানব সভ্যতা ক্রমশ নরক হয়ে উঠছে। তাই কবির কাছেও ‘খিদে আর শ্রমের মিশ্রনে স্নায়ুর কম্পন’ শুরু হয়েছে। ‘ইনসমনিয়ায় নিয়ত ডুবে যায় অসম্পূর্ণ সঙ্গীত’। কবির আকাশ আছে, আকাশে সংক্ষিপ্ত রামধনু হয়ে থাকা আছে। জীবনের পর্যাপ্ত চাহিদা না থাকলেও জীবন আছে। আর জীবন আছে বলেই মৃত্যুরাও গান গাইতে আসে। কবি ফিরে তাকান অতীতের দিকে। নিজের দিকে। অবচেতনের খাতা থেকে মেঘের ভেতর ছুরি লুকানোর গল্প মনে পড়ে যায় তখন। গ্রাম গ্রামের কঙ্কালে হারিয়ে যায়।নরকের দিকে ধাবিত হয়েও এই অন্ধকারকে আমরা মানিয়ে নিতে শিখি। মৃত্যুর ঠিকানা পেয়েও আমরা এখানে স্বপ্ন দেখি। এই সময়ের কথাই সমগ্র কাব্যজুড়ে।

🍁

ঈশ্বর ঘুমিয়ে গেছে : সুকুমার হালদার, রা প্রকাশন, বৈশাখী, প্লট-৭, আর কে পল্লি, নরেন্দ্রপুর, কলকাতা-৭০০১৪৯, মূল্য ২০০ টাকা। প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় ধীমান পাল।

সুকুমার হালদার
কবি তৈমুর খান

Leave a Reply