নিরলস অনুসন্ধিৎসু মন এবং গভীর পর্যবেক্ষণ ও একান্ত নিষ্ঠা নিয়ে লেখা বই

তৈমুর খান

সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু’খানি স্কেচধর্মী টুকরো টুকরো গদ্য সংকলনের বই এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করল। বই দু’খানি হল: ‘পাশাপাশি বাস তবে কেন উদাসীন?’(জানুয়ারি ২০২৩) এবং ‘আলতাফ কেন জেলে বন্দি’ (এপ্রিল ২০২৩)। দুখানি বই-ই সাহিত্যের কোনো বই নয়। একজন সাংবাদিক অথবা সমাজ-গবেষকের গভীর অনুসন্ধিৎসা থেকেই বিচিত্র অভিজ্ঞতার নিরিখে বই দু’খানি লেখা। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্য প্রকরণের কোনো ধারা-ই লেখক অবলম্বন করেননি। কল্পনা বা অনুমানের কোনো সাহায্য নেননি। বরং এক দৃঢ় সত্যের ওপর ভিত্তি করে নিজস্ব কৌতূহল নিবৃত্তি করেছেন। কতগুলো মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন এবং ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটিয়েছেন। এরকম বই বাংলা সাহিত্যে ইতিপূর্বে লেখা হয়েছে বলেও মনে হয় না। আমাদের সমাজজীবনে যে অন্ধতা ও মিথ্যাচার নিয়ে আমরা জীবনযাপন করি— এ বই দুটি সেখানেই সত্যের আলো প্রদর্শন করতে পেরেছে। আমাদের মূঢ়তার, সংকীর্ণতার, যুক্তিহীনতার, কুসংস্কার এবং ভ্রান্তির মরীচিকার মূলে কুঠারাঘাত করতে পেরেছে। সুতরাং সাহিত্য মূল্যে বইগুলির বিচার না করে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানের আলোকে সত্যদর্শী মানবিক মূল্যে আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
সোনা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব সাধারণ ঘরের অতি সাধারণ একজন সামাজিক মানুষ। তিনি সমাজের অন্যায়-অসাম্য, শোষণ-পীড়ন, জাত-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের বিভেদ, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, প্রশাসনিক ভণ্ডামি, ছদ্ম দেশপ্রেম, মন্দির-মসজিদ সংঘাত, সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি, ঘৃণা-বিদ্বেষের সম্পর্ক ইত্যাদি দেখে দেখে ব্যথিত হয়েছেন। এসবের কারণ কী, এর উৎসই বা কী, কেন মানুষকে মানুষ ভাবা হবে না, কেন একটা সম্প্রদায়কে সর্বদা সন্ত্রাসবাদী বলা হবে, কেন একটা সম্প্রদায়ের যেকোনো কাজকে কটাক্ষ করা হবে, কেন তার ধর্ম পালনে তাকে বাধা প্রদান করা হবে, প্রকৃত কারণ না জেনে কেন তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে, কেন বিভেদের রাজনীতি ……. এইসব একরাশ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লেখককে যেতে হয়েছে সমাজের উঁচু স্তর থেকে একদম তৃণমূল স্তরে। মিশতে হয়েছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে। কথা বলতে হয়েছে নেতা-মন্ত্রী, আইন রক্ষক, ধর্মজীবী, কৃষক-শ্রমিক, সেইসব ভিকটিম মানুষদের সঙ্গেও। যে সারসত্য তিনি উদ্ধার করেছেন তা রীতিমতো রোমহর্ষক ব্যাপার। তিনি দেখেছেন এ দেশের শিক্ষিত মানুষরা বিদেশীদের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন, কিন্তু বাড়ির পাশে বাড়ি করে দীর্ঘদিন বসবাস করা মুসলিমদের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না।কিছু মুসলমান বাড়ির দরজায় চট টাঙানো দেখে সব মুসলমানকে একই ভাবা উচিত নয়। তেমনি এক-দুজন মুসলিম পরিবারের সন্তান সংখ্যা দেখে সবাইকে একই রকম ভাবা যায় না। তেমনি মুসলমানদের ঈদ ও রোজা, নামাজ ও হজ্জ নিয়েও অমুসলিমদের নানা কটাক্ষ শোনা যায়। মুসলিমদের বাঙালি বলেও স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। নামকরা কয়েকজন মুসলিম বুদ্ধিজীবীর কথা উল্লেখ করে তাঁদের সহিষ্ণুতা, ত্যাগ ও উদারতার দৃষ্টান্তও দিয়েছেন।শিল্প-সাহিত্য চর্চায় মুসলিমদের অবদান কতখানি এবং তাদের মানবিক ভাবনাও তুলে ধরেছেন। দেশপ্রেমিক হিসেবে তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার এবং আত্মবলিদানের পরিচয়টিও কৌশলে তুলে ধরেছেন। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়েছেন।বিশেষ করে ভাষাদিবসের কথা এবং বাঙালিত্বের স্বরূপ বোঝাতে মুসলিমদের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। পুলিশ প্রকৃত আসামিকে ধরতে না পেরে দূর দেশ থেকে আসা একজন নিরীহ সাধারণ মুসলিমকে কিভাবে আসামি করে সারাজীবন জেলে রেখে দেয় শুধু নিজস্ব ক্যারিসমা জাহির করার জন্য সেই গল্পটিই আলতাফের।একটা উদাহরণের আড়ালে তিনি বহু নিরীহ লোকের এভাবে জেলযাপনের কথা বলেছেন। দেশের হলুদ সাংবাদিক, সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদ, গোরক্ষক বাহিনী, সন্ত্রাসী এবং লাভজিহাদী রক্ষকের উদয় কতখানি মারাত্মক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তা তুলে এনেছেন। সমসাময়িক নানা ঘটনার উল্লেখ করে আমাদের দেখিয়েছেন। খুব বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে প্রতিটি ঘটনার সম্মুখীন করেছেন। দেশ ও জাতি গঠনে, স্বাধীনতা সংগ্রামে, ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রশক্তিতে, গৌরবে ও মাহাত্ম্যে মুসলিমদের বাদ দিয়ে কখনো সম্পূর্ণ ভারতবর্ষের কথা ভাবাই যায় না। নিবন্ধগুলির শিরোনামেই লেখকের মানবিক স্পর্ধা এবং বিদ্রোহের অভিরূপ ফুটে উঠেছে। কয়েকটি উল্লেখ করছি: আলতাব কেন জেলে!, সব জেলবন্দিই কি অপরাধী!, কারাগারের ভিতরে, এনকাউন্টার হত্যা, মানবিক মুখের স্বীকৃতি দাবি, গণপ্রহরের কেন এই প্রবণতা?,প্রহসনের এই সমাজ, সবার কাছে অপ্রিয় হলে কি মানুষটা খারাপ?, শিক্ষাদানের পেশায় এঁরা কতটা উপযুক্ত?, শহুরে বাবুদের তাচ্ছিল্য, পাশাপাশি বাস,তবে কেন উদাসীন?, মুসলিম সম্বন্ধে এই ভ্রান্ত ধারণা কবে ঘুচবে?, রোজা: চাই ধারণার মধ্যে স্বচ্ছতা, ঈদের সকালে একি শুনলাম?, এড়িয়ে চলতে চাওয়াতেই বেড়েছে দূরত্ব, কাছাকাছি আসি ক’জন?, বাংলা সিরিয়ালে মুসলমান বাঙালি সমাজ ও চরিত্র, এঁদের হাতেই তৈরি হবে আগামী প্রজন্ম?, ধর্মীয় বিভেদকে শত শত হাত দূরে সরিয়ে বাংলার উৎসবের সম্প্রীতির মেলা, কবে বুঝব আমরা ‘বাঙালি’ কারা, ২১শে ফেব্রুয়ারির আক্ষেপ ইত্যাদি বহু রচনা। একটা ঐক্যবদ্ধের দেশ, সম্প্রীতির দেশ, ভালোবাসার দেশ, স্বপ্নের দেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই লেখকের এই ভাবনা এবং প্রয়াস খুব পজিটিভ প্রভাব ফেলবে বলেই আশা রাখি। নিরলস অনুসন্ধিৎসু মন এবং গভীর পর্যবেক্ষণ ও একান্ত নিষ্ঠা না থাকলে এরকম বই লেখা সম্ভব নয়। এইসময়ের সকল শিক্ষিত মানুষেরই বই দু’খানি পাঠ করা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করি।

১,পাশাপাশি বাস তবে কেন উদাসীন? :সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়, উদার আকাশ প্রকাশনা, ঘটকপুকুর, ভাঙড়,গোবিন্দপুর-৭৪৩৫০২, প্রচ্ছদ মৌসুমী বিশ্বাস, মূল্য ১২৫ টাকা।

২,আলতাফ কেন জেলে বন্দি: সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়, উদার আকাশ প্রকাশনা, ঘটকপুকুর, ভাঙড়,গোবিন্দপুর-৭৪৩৫০২, প্রচ্ছদ তপন রায়, মূল্য ১৩০ টাকা।


