বর্তমান সময়ে একটি হারিয়ে যাওয়া লৌকনাট্য ধারার মধ্যে অন্যতম হল যাত্রাপালা । তিন চার ঘন্টা ধরে এক নাগাড়ে মানুষেকে বিনোদন দিতে পারে। এখানে অপেশাদার যাত্রা অভিনয়ের কথাই বলছি। যেখানে অভিনেতা অভিনেত্রীরা মেকাপের আড়ালে থাকে নিজের পরিবারের বা পাড়ার পরিচিত মুখ। চার দিক খোলা মঞ্চে জন সমুদ্রে নিজেকে অভিনয়ের মধ্যে আনন্দ, দুঃখ, ব্যাথা কৌতুক দিয়ে নিজের অভিব্যক্তি ব্যাক্ত করতে সুযোগ পায়। লেখাপড়া কম জানা বা না জানা মানুষের একটা লৌক শিক্ষার অঙ্গন হল যাত্রা। যেখানে নিজের সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি দ্যাখে নিজেকে সুধরে নেওয়ার সুযোগ থাকে। আবার কখনো কখনো অন্যায় বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পায়। তাইতো রাষ্ট্র সব সময় যাত্রা কে ভয় পেয়েছে ব্যান্ড করছে।
বাপের বাড়িতে যাত্রা দেখতে শ্বশুর বাড়ি থেকে মেয়ে দু দিনের জন্য হলে বাড়ি আসার সুযোগ পেয়েছে।
গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ সারা বৎসর কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে কষ্ট সৃষ্টে দিন যাপন করে। তখন নিজেদের বিনোদনের মাধ্যম হয় কোন পূজা পার্বনকে উপলক্ষ করে যাত্রা অনুষ্ঠান। বর্তমান সময়ে বহুমুখী বিনোদনের উপকরনের বাড় বাড়ন্তে গ্রামীন অপেশাদার যাত্রা শিল্পে এসেছে ভাটার টান। এছাড়া লাগাম ছাড়া খরচের বহর আরেক কারণ। আর যাত্রার সঙ্গে ধুঁকছে অপেরা হাউস বা ড্রেস হাউস গুলো সমতালে।
তবুও পুরুলিয়া জেলার গদীবেড়ো গ্রামের বিভিন্ন পাড়ায় আগে ফি বৎসর যাত্রা হোত। নামো পাড়ায় চৈত্র মাসের ১১ তারিখ শ্রী শ্রী লক্ষী জনার্দন মন্দিরের প্রতিষ্ঠার দিন স্মরণে যাত্রার রেওয়াজ ছিল।
যাত্রার জন্য রঘুনাথপুর শহরের ড্রেস হাউস থেকে মহিলা শিল্পীসহ ও ড্রেস আসতো চিরাচরিত গরুর গাড়ি চড়ে। আমার ঠাকুর দা স্বর্গীয় গোপাল মণ্ডলের মুখেও শুনছি গরুর গাড়ি করে যাত্রা জিনিসপত্র আনার কথা। বাদ্য বাজার দল যখন গরুর গাড়ি চড়ে আসতো যখন আমরা সকলে তাদের দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। যারা যাত্রার গ্রাম্য পাড়ার কলা কুশলী তারা কত দিন মাঠে ঘাটে কৃষি কাজে যাত্রার ডাইলগে আকাশ বাতাস মথিত করত।
প্রতিদিন পাড়ার মন্দির প্রাঙ্গণে বসে বসে রেহারসেল দেখা ছিল আমাদের আনন্দের একটা উপায়। শুনে শুনে আমাদেরও পাঠ মুখস্থ হয়ে যেত বৈকি। এই যাত্রা থেকে অনেক নবাগত শিল্পী উঠে এসেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
যাত্রার দিন দুপুর থেকে স্টেজের পাশে বস্তা পেতে জায়গায ঘেরা ছিল একটা বীরত্বের কাজ। আবার অনেক ছেলে মেয়ে চকলেট বিক্রি, পাঁপড় ভাজা বা ঘুঘনি বিক্রির মধ্যে খুঁজে পেত অপার আনন্দ । পলাশ পাতার দনায় কাঁচা তালপাতার চামছে ঘুঘনি খাওয়ার আনন্দ আজ আর কোথায় ?
নূতন পাড়ায়, বাগিচায় স্বরস্বতী পূজোতে না কোন একটা সময় যাত্রা দেখেছি। পরে যাত্রার রেওয়াজ কমে গেলেও সমস্ত পাড়ার যাত্রা প্রেমীদের প্রচেষ্টায় এই চড়ক গাজনে কয়েক দিন ধরে যাত্রা এখনও হয়ে আসছে বলে খুব ভালো লাগলো। যারা যাত্রায় অভিনয় করে তারা জানে কত দিন রাত্রির ঘুম কেড়ে নেওয়ার সাধনা এই যাত্রা। আর কত মেহনতে দুপয়সা আয় আর অনুনয় বিনয় করে চাঁদা আদায় করে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা। আমিও কয়েকটা নাটক ও যাত্রায় অংশ নিতে পেরে আনন্দ পেয়েছি।
আমাদের নামোপাড়ায় যাত্রা করতেন অনেক দিন আগে স্বর্গীয় উমাপদ মণ্ডল( জেঠু) , স্বর্গীয় মনোহর মণ্ডল, স্বর্গীয় আশুমাজী, স্বর্গীয় কালিপদ মাজী, মানিক গঁরাই ইনারা আবার তখন কেউ কেউ মহিলা সেজে মহিলার অভিনয় করতেন শুনেছি স্বর্গীয় কালিপদ মাজীর গল্পে । তখন ড্রেস হাউস থেকে মহিলা শিল্পী আনার চল শুরু হয়নি। এছাড়া পরে পরে দাতারাম মাজী, হীরালাল মণ্ডল মানিক মণ্ডল, রঞ্জিত মণ্ডল, মিহির মণ্ডল, ফণিভূষণ মণ্ডল, কৃপাসিন্ধু মণ্ডল, আশুতোষ মণ্ডল, সুনীল মণ্ডল, অনিল মন্ডল, ধনঞ্জয় মণ্ডল, উমাপদ মণ্ডল, নারয়ন মন্ডল, মণ্ডলের যাত্রা করতে দেখছি। বাবলু মাজী, স্বর্গীয় ভালোনাথ মাজী, স্বর্গীয় চঞ্চল মাজী পরে পরে যাত্রা করেছে।
নূতন পাড়র একজন ভালো অভিনেতা মাগারাম চক্রবর্তী, স্বর্গীয় করুণা দা, নিমাই চক্রবর্তী, সুবোধ চক্রবর্তী আরো অনেকে। কামিক্ষা পরামানিক, সত্যেন দে, সম্পূর্ণ দে, শৈলেন দে রা তো শিল্পী মানুষ।
বেনে পাড়ায় শ্যামাপদ মুদি, ভীম মুদি আরো অনেকে।
বাজার পাড়ায় সুধাময় দা, শোভারাম চক্রবর্তী, স্বরূপ দা, রাজেশ চন্দ্র, বুবাই চক্রবর্তী আরো অনেকে।
যে যাত্রা গুলোর নাম মনে পড়ছে ” পাঁচ পয়সার পৃথিবী, অচল পয়সা ” ,
যাত্রায় ভালো আমপাতার বাঁশি ও হারমোনিয়াম বাজাতেন বদী সেন রঘুনাথপুর থেকে প্রতি যাত্রায় আসতেন।
স্বর্গী মাহাদেব কৈবর্ত প্রাক্তন প্রাথমিক শিক্ষক প্রম্পটারের কাজে বসতেন হালকা চিমনির আলোতে । তিনি পরে বেড়ো থেকে ঠেকাড়াতে বসতি করেন।
কালচক্রে অনেকের নাম মনে করতে পারছি না বলে দুঃখিত – – –
পুলিশের সাজে রাজেশ চন্দ্র ও বুবাই চক্রবর্তী। যাত্রার নাম ” সূর্য ফিরছে মায়ের কোলে “। সময় চড়ক গাজন, গদীবেড়ো গ্রাম।
কালচক্রে অনেকের নাম মনে করতে পারছি না বলে দুঃখিত – – –
পুলিশের সাজে রাজেশ চন্দ্র ( থানার মেজো বাবু) ও কৌশিক চক্রবর্তী ( বড় বাবু) বুবাই । যাত্রার নাম ” সূর্য ফিরছে মায়ের কোলে “। সময় চড়ক গাজন, গদীবেড়ো গ্রাম।
বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল