বই আলোচনাঃ মোস্তাক আহমেদের বৃক্ষ, আমি ও আমরা’
স্বপ্নের সবুজ গানে সৃষ্টির মেঘ আরাধনা
কবি মোস্তাক আহমেদ মাটির মানুষ। ওনার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বৃক্ষ, আমি ও আমরা’। লালমাটি থেকে প্রকাশিত ছাপান্নটি অসামান্য কবিতার সংকলন এটি গতবছর আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। বইটা বারাসাত বাস স্টান্ডের বড়ো কালি মন্দিরের পাশের একটা বই স্টলে আমি হঠাৎ পাই। আর পেয়েই চোখ আটকে যায় কালিকলমের নিবিড় পাতায়। উৎসর্গপত্রে কবি লিখছেন, ‘যে বৃক্ষের তলায় অগুনতি স্বপ্নের সমাবেশ…’। প্রকৃতির প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে এমন উদাত্ত আহ্বান এ যুগের আর কোনো কবি এমন অকপটে করতে পেরেছেন, বলে আমার মতো সামান্য অক্ষর কারিগরের জানা নেই। যদিও জানার ব্যপ্তি খুবই সামান্য। ভুলত্রুটি থাকলে মাফ করে দেবেন। অতিকথন বাদ দিয়ে এবার সরাসরি কবিতার কথায় আসি। প্রার্থনা, আমরা-ওরা, খাপছাড়া, প্রেরণা, আবেশ সব কবিতাই আমার ক্ষুদ্র বিচারে মনোগ্রাহী। কিন্তু আপস, আগমনি, ছুতমার্গ, প্রলাপ কবিতাগুলো আমার কাছে অসাধারণ বললেও অত্যুক্তি হবে না। কবিতাগুলো আকৃতিতে যতটাই ছোট, ভাবনাগুলো ঠিক ততটাই গভীর। অতলে ডুব দেওয়ার দক্ষতা সকলের থাকে না। কবিকে আন্তরিক ধন্যবাদ এইসব অমোঘ সৃষ্টিসম্ভারের জন্য। ছায়া-কারবারি, বিনয় মজুমদার, বিভূতিভূষণ, ভার্চুয়াল, উপলব্ধি, প্রতিযোগী প্রভৃতি নানান কবিতা বেশ প্রশংসার দাবি রাখে। সামাজিক জীবন, রাজনীতি, বিজ্ঞান, ঈশ্বর, পুরান, দেহতত্ত্ব, নগরকেন্দ্রিকতা, পরিবার, দ্বিধা এসবকিছুই আলোচ্য গ্রন্থে সুন্দর ভাবে সন্নিবিষ্ট। কোনোকিছুরই অনুপস্থিতি রচনাগুলি পড়তে গিয়ে পাঠকদের মনে হবে না, উপরন্তু কবিতার অবগাহনে নিমজ্জিত হয়ে অপার শান্তি লাভ করতে পারবেন তাঁরা, আনন্দ লাভে ভরে উঠবে আমাদের নিত্যকার কর্ম ব্যস্ততায় ক্ষুধাতুর সুকোমল চির পাঠক-মন।
কবিতার ভাষা সহজ, সাবলীল অনুভবী পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হবে না। অথ উমা-কথা ছাড়া ছন্দের কবিতা এই কাব্যগ্রন্থে নেই বললেই চলে, তবে তাতে কবিতার আত্মা কোনো জায়গাতেই ক্ষুণ্ণ হয় নি। নমুনাস্বরূপ,
‘ধর্ষণ’ কবিতায় কবি লিখছেন,
‘অপারেশন থিয়েটারে মায়ের বুক চিরি
হৃৎপিণ্ড জুড়ে ধর্ষণ প্রলেপ
নিরুপায় হাত দুটো পকেটে রাখি
অসুস্থ মা আমার
আরও ধর্ষণের প্রতীক্ষায়…’
আশা করি, পাঠককে বলার অপেক্ষা রাখে না সমকাল কী বিপুল গভীরতা নিয়ে নেপথ্যচারী সাধক কবির শাণিত লেখনীতে কী দৃপ্ত ভাবে ফুটে উঠেছে।
কাব্যগ্রন্থের সামগ্রিক নির্মাণে সংশয়, নীরবতা থাকলেও আশাবাদী কবি খুব সচেতন ভাবেই উন্নীত হয়েছেন আগামীর সেই গন্তব্যে, যেখানে তিনি প্রকৃতি মায়ের সেই ছোটোবেলার কোলে বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন; কাব্যগ্রন্থের সমনামের সেই কবিতার শেষ চরণে কবির সেই আশা ধ্বনিত হয়েছে, ‘সে বৃক্ষের কাছে ফিরে আসা বার বার তাই’।
এখানেই কবির সার্থকতা লাভ। কবিতার এই টানেই আমি একচল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় বসে ‘বৃক্ষ, আমি ও আমরা’ -র স্বাপত্য বন্দনায় মগ্ন।
মনের আকাশ সত্যিই খুব ভারি হয়ে উঠছে। বৃষ্টি কি আর আসবে না! প্রেমের মানুষ কবি মোস্তাক আহমেদ কী বলবেন?
অমিতাভ সরকার
বারাসাত, কলকাতা-৭০০১২৪
প্রথম ছবিঃ বইয়ের প্রচ্ছদ
দ্বিতীয় ছবিঃ ডঃ মোস্তাক আহমেদ
তৃতীয় ছবিঃ অমিতাভ সরকার
ডঃ মোস্তাক আহমেদ