You are currently viewing Article

Article

ভিজে ভাতের দিনে

বারিদ বরন গুপ্ত

#দ্বিতীয় পর্ব #

প্রাচীন বাংলায় ‌ মুড়ির খুব একটা প্রচলন ছিল না! তখন লোকজন তিন বেলাই ভাত খেত! বলতে গেলে এটাই রেওয়াজ ছিল! এখনো অনেক জায়গায় তিনবেলাতেই ভাত খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। ওপার বাংলায় তো তিন বেলায় ভাত খাওয়ার রেওয়াজ বরাবরই ছিল, এখনো সেটা বজায় রয়েছে! এখনো নদীয়া জেলার বেশ কিছু জায়গার লোক তিনবেলা ভাতই খায়, গত বছর একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে সেটা টের পেয়েছি। আসলে ভাতের প্রতি বাঙালির সেই সাবেক কালের টান, তাই বলা হয় ভেতো বাঙালী!

আমি মেদিনীপুর এবং চব্বিশ পরগনা দুই জেলায় দেখেছি ভিজে ভাতের প্রতি মানুষের কতটা আগ্রহ আবেগ ভালবাসা জড়িয়ে আছে! মেদিনীপুরের ঘাটাল ঝারগ্রাম প্রকৃতি জায়গায় বেশ কিছুকাল ছিলাম, ওখানেও দেখেছি ভিজে ভাত খাওয়ার কত আইটেম! কখনো চুনো মাছ পেঁয়াজ মাখিয়ে, বড়ি ভেজে তাকে ঘুরিয়ে আলুর সাথে মাখিয়ে, পিঁয়াজ লংকা ভেজে গুঁড়িয়ে , কখনো বা চুনো মাছের টক দিয়ে! এইসব আইটেম দেখেই তো জিভে জল আসে, এখন সেসব সুখে স্মৃতি মুখে লেগে আছে।

আজ ‘ভিজে ভাতের দিনে’ লিখতে গিয়ে মন্টুদার কথা মনে পড়ে গেল! আমি তখন থাকতাম হাওড়ার পিলখানার কাছে উঁড়েপাড়ায়। ওখানে, মন্টুদার একটা মুদিখানা দোকান ছিল। মন্টুদার বাড়ি ছিল মেদিনীপুর জেলায় ঘাটাল মহকুমায় দাসপুর ব্লকের চাইপাটে। মেদিনীপুরের লোক, বুঝতে পারছেন ভিজে ভাতের প্রতি বরাবরই একটা লোভ! যাইহোক হাওড়া জেলার ডোমজুড়ের মোহন বলে একজন মন্টুদার দোকানে কাজ করতো, রান্নাবান্নার দায়িত্বটা ওই মোহনের উপরই ছিল। এই গ্রীষ্মকালে মন্টুদা মোহন দা কে বিকেল তিনটের সময় বাসায় পাঠাতো ভিজে ভাতে জল দেওয়ার জন্য, আর মোহনদার ছিল ভাতে জল কম দেওয়ার এক বদ অভ্যাস! ব্যাস! রাতে খেতে বসার সময় তুমুল ঝগড়া ভিজে ভাতের জল নিয়ে। আমি বলতাম খাবে তো ভিজে ভাত, তো জলের অত কি দরকার? তখন মন্টুদা বলতো—

” ভিজে ভাতের জল হাজার হাতির বল”

তখন জানলাম যে ডাক্তার ব্যানার্জি তো ঠিকই বলতেন! ভিজে ভাতে ক্যালসিয়াম পটাশিয়াম আয়রন ইত্যাদি বেশি থাকে, আর অ্যালকোহল তৈরি হয় বলে রাতে ঘুমটাও জোরদার হয়! দুঃখের কথা মন্টু দা, আজ আর বেঁচে নেই, বছর দশেক হলো এই পৃথিবী ত্যাগ করেছেন! তা তার এই হাজার হাতির বলের কথাটা আজকে বারে বারে মনে পড়ছে, তবে ভিজে ভাতে যে শরীর ঠান্ডা হয় এবং ক্লান্তি দূর হয় এ কথাটা আমরা ছোটবেলায় অনেকবার শুনেছি দাদু ঠাকমার কাছে!

শুধু মন্টুদা নয়, আমরাও ছোটবেলায় ভিজে ভাতের কাঙাল ছিলাম! ভিজে ভাত খাওয়া নিয়ে ঝগড়া ভাই-বোনদের মধ্যে কম হয়নি! তখন গ্রীষ্মকালে স্কুল হতো সকাল বেলায়! ওই এপ্রিল মে জুন তিন মাস! তখন স্কুলগুলোতে গ্রীষ্মের ছুটি কম দেওয়া হতো, তার পরিবর্তে বর্ষার ছুটি দেওয়া হতো প্রায় একমাস! তার একমাত্র কারণ বর্ষায় পাড়াগাঁর রাস্তাঘাট আর চাষবাস! যাই হোক গ্ৰীষ্মে প্রাক দুপুরে স্কুল থেকে ছুটে বাড়ি ফিরে, সোজা রান্নাঘরে ভিজে ভাতের খোঁজ! ভাগে কম পরলে রান্না ঘর তোল মাতাল হতো! নিদেন পক্ষে ভিজে ভাতের জল দিয়ে মুড়িটাও খাওয়া চাই। তারপর পুকুর তোল মাতোল করতাম, কখনো কখনো অভিভাবকরা তেড়ে আসতেন, ঢেলা ছুড়ে পুকুর থেকে তুলতে হতো! কারো ভাগে জুটতোকঞ্চির বাড়ি! সবই ভিজে ভাতের জের আর কি!

সত্যিই ভিজে ভাতের সাথে বাঙালির যেন একটা নাড়ির টানছিল! এখন যেমন জলখাবারে মুড়ি বা নানান খাবারের ফিরিস্থি! তখন জলখাবার মানেই ভিজে ভাত! যারা দূর মাঠে কাজ করতে যেত, তারাও ছাদা বেঁধে ভিজে ভাত নিয়ে যেত! মাঠ থেকে ফিরতো তো সেই দুপুরবেলায়!

তখন বাঙালি কৃষিজীবী পরিবারের গোয়াল ভর্তি গরু থাকতো! রাখাল বাখালের দল জলখাবার বেলায় ভিজে ভাত খেয়ে ছুটতো গরুর পিছনে পিছনে! প্রখর রোদ থেকে বাঁচতে কখনো আম বাগানে, নয়তো কোন গাছের তলায় খেলার আয়োজনে! আজকে এই ভিজে ভাতের গল্প লিখতে লিখতে আমার সেই অবনীদার কথা মনে পড়ে গেল! আমার পিসতুতো দাদা, বয়সে দেড় কুড়ি বেশি! সেও ছিল ভিজে ভাতের কাঙাল! শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বলে কিছুই নেই, জলখাবারে ভিজে ভাত চাই-ই! তো প্রত্যেকদিন এক পেট ভিজে ভাত খেয়ে সটান গরুর পেছনে পেছনে মাঠে, তারপর গামছা পেতে কখনো নেউল গড়ের পাড়ে বটতলায়, নয়তো ডিভিসির ক্যানেলের ওই অশ্বথ তলায়, দিব্যি একটা দিবানিদ্রা! পেটে যখন ভিজে ভাতের অ্যালকোহল বাড়তো তখন নাক ডাকার শব্দে গরু গুলো কখন যে গ্রামের পথ ধরেছে টের পেত তখন যখন গাছ তার ছায়া সরিয়ে নিয়েছে! আজকে মন্টু দা নেই, অবনী দা নেই, এমনকি ভিজে ভাতও নেই, শুধু কথাগুলোই যে রয়ে গেল—

” হায়রে চলে গেল সে সব দিন আঁধারে
ভিজে ভাতের কাহিনী আজ শুনায় কাহারে”

নমস্কার: কেমন লাগলো? বারিদ বরন গুপ্ত (পূর্ব বর্ধমান)

inbound5820095712650352464.png

Barid Baran Gupta

Leave a Reply