inbound1163565697839850459
inbound1163565697839850459

Article

অশোক ষষ্ঠীর আড়ালে

বারিদ বরন গুপ্ত (পূর্ব বর্ধমান)

বাঙালি বারো মাসে তেরো পার্বণ, আর আছে হাজার লৌকিক অনুষ্ঠান, আচার-বিচার লোকাচার প্রথা ইত্যাদি! তার মধ্যে সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক লোকাচার প্রথা হারিয়ে গেছে, তবে এখনো বেশ কয়েকটা টিকে রয়েছে, যদিও বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার গ্রহণযোগ্যতা হয়তো ততটা নেই, তবুও প্রাচীন সংস্কৃতির ঐতিহ্য যে এখনো টিকে আছে সেটাই অনেক, তার মধ্যে অন্যতম হলো ষষ্টী দেবীর আরাধনা, সাধারণত মাতৃ গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার ষষ্ঠ দিনে সদ্যোজাতোর পক্ষে দেবী ষষ্ঠীর উদ্দেশ্যে দীর্ঘ জীবনের প্রার্থনা কামনায় ষষ্ঠী পূজার পটভূমিকা তৈরি করে বলে মনে হয়। এই আরাধনা কে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে প্রত্যেক জনপদে গড়ে উঠতে থাকে ষষ্ঠীতলা, যা এখনো রাঢ় বাংলার প্রায় প্রতিটি জনপদে দেখা যায়!

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানান ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী প্রথা, সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বাঙালি জীবন সংযুক্ত! বনচারি মানুষ এক সময় পশু পালক সভ্যতার মধ্য দিয়ে স্থায়ী বাসভূমির খোঁজ পেয়েছিল, অবশ্যই তা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে, যেখানে জীবন ধারণের সব উপাদান সহজেই সংগ্রহ করা যায়। পরবর্তীকালে তাদের জীবনের নানা বাধা-বিপত্তি এসে হাজির হয়েছে, জীবন বারে বারে নানা বিপত্তির মধ্যে দিয়ে গেছে, হারাতে হয়েছে শত শত জীবন ও সম্পত্তি! এক সময় তারা অভিঞ্জতায় উপলব্ধি করেছিল হয়তো এগুলো প্রকৃতির খেলা, তাই একসময় যাদু তুকতাক দিয়ে প্রকৃতিকে বশে আনার চেষ্টাও করেছে, যখন বিফল হয়েছে তখন প্রকৃতির কাছে শরণাপন্ন হয়েছে, শুরু হয়েছে প্রকৃতি আরাধনা, অবশ্যই তারা টোটেম প্রথায় গাছ পাথর ইত্যাদিকে আরাধনার মাধ্যমে সন্তুষ্ট করে নিজেদের জীবনকে নিষ্কণ্টক করতে চেয়েছিল, এভাবেই পরবর্তীকালে গড়ে উঠেছিল চন্ডী, ধর্ম, মনসা প্রভৃতি লৌকিক দেবদেবীর আরাধনা!

একসময় কৃষিভিত্তিক সভ্যতাকে কেন্দ্র করে জনপদ গড়ে উঠতে থাকে! পরবর্তীকালে জনপদের আয়তন বাড়ার সাথে সাথে, লৌকিক দেবদেবীর আরাধনার পাশাপাশি যুক্ত হয় বিভিন্ন আচার বিচার লোকাচার প্রথা ইত্যাদি, আর এই লোক আচারের মধ্যে অন্যতম হলো ষষ্টী দেবীর আরাধনা! গ্রামের মধ্যস্থলে বা একপাশে গড়ে উঠতে থাকে ষষ্টিতলা! অবশ্যই সদ্যোজাতের সুস্থতা বা মঙ্গল কামনার উদ্দেশ্যে জন্মের ষষ্ঠ দিনেই এই আচার অনুষ্ঠান, তাই এই অনুষ্ঠানের নাম ষষ্ঠী!

উল্লেখ করা যায় যে সভ্যতার প্রথম দিকে গ্রামের অভিজ্ঞ বয়স্কা মহিলারাই সন্তান প্রসবের কাজটি সম্পন্ন করত, পরবর্তীকালে গ্রাম যখন স্বয়ংসম্পূর্ণতায় আবদ্ধ হয় তখন গ্রামে বিভিন্ন পেশা ভিত্তিক জাতি যেমন কামার, কুমোর, ধোপা নাপিত ইত্যাদির উদ্ভব ঘটে, তেমনি হাড়ি ডোম প্রভূতি জাতির মহিলারা পেশা ভিত্তিক ধাইয়ের ভূমিকা পালন করে! তারা সন্তান প্রসব থেকে সন্তানের বিভিন্ন আচরণ ক্রিয়া অর্থাৎ ষষ্ঠী দেবীর উদ্দেশ্যে আরাধনার কাজটাও সম্পূর্ণ করত! এখন গ্রামেগঞ্জে ধাইদের কাজ হসপিটালের পেশা ভিত্তিক নার্স ডাক্তাররা পালন করছে, তবুও সেই ঐতিহ্য আচরণ ক্রিয়াটা কিন্তু এখনো ধাইদের হাতেই আছে! জন্মের ষষ্ঠ দিন ষষ্ঠী বা বিবাহের আনুষাঙ্গিক কাজটা এখনো ঐতিহ্য মেনে ধাইদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়নি! গ্রামগঞ্জে এখনো ধাইমারা পূজা পার্বণ বিবাই ইত্যাদি অনুষ্ঠানে তাদের যজমানি পাওনা মিটিয়ে নিয়ে যায়!

রাঢ়ে আর্যীকরন শুরু হয় খুব সম্ভবত মৌর্য যুগের শেষ পর্বে এবং শেষ হয় প্রায় সেন যুগের মাঝামাঝি পর্বে! এই সময় পর্ব থেকে বিভিন্ন পৈরাণিক কাহিনীর অবতারণা ঘটে, ফলে সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মের উৎপত্তি হয় বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান এবং প্রথার! চন্ডী, ষষ্ঠী ,বিষ্ণু, ব্রহ্মা, মহেশ্বর প্রভৃতি দেব দেবীকে কেন্দ্র করে নানান আচরণ ক্রিয়া গড়ে উঠতে থাকে! খুব সম্ভবত সেন যুগেই মনসা, ষষ্ঠী প্রভুতি দেবী ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির মধ্যে এসে যায়। তৈরি হয় ষষ্টী দেবীর আরাধনা কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন আচরণ ক্রিয়া! যেমন জৈষ্ঠ মাসে অরণ্য ষষ্ঠী, শ্রাবণ মাসে লোটন বা লুন্ঠন ষষ্ঠী , ভাদ্র মাসে চাপড়া ষষ্ঠী, আশ্বিন মাসে দুর্গা ষষ্ঠী, অঘ্রাণ মাসেই মূলা ষষ্ঠী, পৌষ মাসে মাকাল ষষ্ঠী, মাঘ মাসে শীতলা ষষ্ঠী, সেরুপ চৈত্র মাসে শুক্লপক্ষে অশোক ষষ্টী, একে অনেকে স্কন্ধ ষষ্ঠীও বলেন!

উল্লেখ করা যায় যে অশোক ষষ্ঠীর নামের সাথে অশোক গাছের নামটাও জড়িয়ে আছে, আর আছে পৌরাণিক এক গল্প কাহিনী-‘একদা এক মুনি অশোক বনে আরাধনা করতেন, তিনি একদিন পূজার ফুল আনতে গিয়ে দেখলেন এক সুন্দরী বালিকা অশোক গাছের নিচে ক্রন্দন করছে, তিনি করুনাবশত তাকে আশ্রমে নিয়ে আসেন , এক হরিণ রুপী মা তাকে দুগ্ধ পান করাতো, অশোক বনে পাওয়া গেছিল বলে তার নাম হয় অশোকা! আস্তে আস্তে সে যখন বিবাহযোগ্য হল তখন আশ্রমে আগত এক রাজপুত্রর সাথে তার পরিণয় সম্পন্ন হয়, সেই অশোকা যখন পতি গৃহে যাত্রা করে তখন মুনি তাকে অশোক ফুল এবং বীজ সঙ্গে দেন এবং তা গৃহ পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়ার উপদেশ দেন সঙ্গে চৈত্র মাসে শুক্লপক্ষে ষষ্ঠী ব্রত পালনের নির্দেশ দেন, যাতে করে পরবর্তীকালে অশোক গাছের সারি দেখে আশ্রমে ফিরতে পারে, যাইহোক পরে সে সাতপুত্র এবং এক কন্যার জন্ম দেয়! এর পরবর্তীকালে কন্যা ও পুত্রদের বিবাহ হয়, কিন্তু এমন সময় ঘটল এক অঘটন, অশোকার শ্বশুর গত হয়, উল্লেখ্য অশোকার শ্বশুরের শ্রাদ্ধের দিন ছিল চৈত্র মাসের শুক্লা পক্ষের ষষ্ঠী, সে তা ভুলে যায় এবং শ্রাধ্যান্ন ভক্ষন করে , পরের দিনই তার সাত পুত্র এবং বৌমা মারা যায়! তখন তার সেই পালক পিতা মুনির কথা মনে আসে, এদিকে সেই অশোক বীজ সারিবদ্ধভাবে বৃক্ষাকারে মুনির আশ্রম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, বলে তার পথ চিনতে কোন অসুবিধা হলো না, সেখানে সে মুনিকে সবিস্তারে সব জানালো, তখন মনি সব বুঝতে পেরে তাকে কমন্ডল থেকে মন্ত্রপুত জল দিয়ে মৃত সন্তানদের ওপর ছিটিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন, এবং আরো জানালেন যে চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীর দিনে‌ ছটি অশোক ফুলের কুড়ি দই বা কলার সাথে দন্তচ্ছেদন না করে গলাধঃকরণ করতে, এবং ব্রত শেষে মুগকলাই উদরস্থ করে ব্রত ভঙ্গ করতে! এরপর সে পালক পিতা মুনির কথা মত বাড়ি এসে সাত ছেলে এবং বৌমাকে ফিরে পায় এবং সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে!’

উল্লেখ করা যায় যে এসব গল্প কাহিনীর বাস্তব সত্যতা থাক বা না থাক কিন্তু এই এইসব গল্প কাহিনী গুলো একসময় স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজে মানুষজনকে আবিষ্ট করেছিল এবং বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালনে যে উদ্বুদ্ধ করেছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই! তাছাড়া ব্রতটার নাম অশোক ষষ্ঠী, অশোক গাছের সাথে সম্পর্কিত! তাছাড়া ও এই ব্রত উদযাপনের সাথে আবশ্যক সম্পর্কিত অশোক গাছের বীজ এবং পুষ্প কাঠালি কলা সহ গলাধঃকরণ, যা এই অনুষ্ঠানের সাথে যথেষ্ট অর্থবহি হয়ে উঠেছে,যার সমাজতাত্ত্বিক মূল্য কিন্তু যথেষ্ট! অশোক গাছ Fabiscee পরিবারের ঔষধি গুনসম্পন্ন এক বৃক্ষ, বৈজ্ঞানিক নাম Saraca asoca , যার গাছের ছাল ফুল এবং বীজ আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে স্ত্রী রোগ নিরাময়ে ধন্বন্তরী ঔষধ যা মহিলাদের ঋতুচক্র নিয়ন্ত্রণ করে, বন্ধ্যাত্ব দূর করে এবং গর্ভধারণে সাহায্য করে! তাই ষষ্ঠী পূজার আচার-আচরণগুলো প্রজননের সাথে সম্পর্কিত! সেই সভ্যতার বিকাশ পর্বে গ্রাম্য সংস্কৃতির পটভূমিতে এই ধরনের আচার অনুষ্ঠানের গুরুত্ব কে কখনই অস্বীকার করা যায় না!

স্বপন কুমার বৈদ্য
স্বপন কুমার বৈদ্য
তৃষ্ণা বসাক
তৃষ্ণা বসাক
Learn for earn
Learn for earn
মহা রফিক শেখ
মহা রফিক শেখ
মুহাম্মদ আস্রাফুল আলম (সোহেল)
মুহাম্মদ আস্রাফুল আলম (সোহেল)
সাকিব আহম্মেদ
সাকিব আহম্মেদ
তফিল উদ্দিন মণ্ডল
তফিল উদ্দিন মণ্ডল
অভি বিশ্বাস
অভি বিশ্বাস
কাছেন রাখাইন
কাছেন রাখাইন
মোঃ আলী সোহেল
মোঃ আলী সোহেল
রতন বসাক
রতন বসাক
বারিদ বরন গুপ্ত
বারিদ বরন গুপ্ত
দেবাশীষ  চক্রবর্তী
দেবাশীষ চক্রবর্তী
প্রদীপ ভট্টাচার্য
প্রদীপ ভট্টাচার্য
বারিদ বরন গুপ্ত
বারিদ বরন গুপ্ত

inbound1163565697839850459

Barid Baran Gupta

Leave a Reply