চ্যারিটি
বিদিশা মুখার্জি
আজ দু’দিন হলো নিজের গ্ৰামে এসেছি দীর্ঘদিন পরে। এককালের গ্ৰামের ‘মধোকে’- গ্ৰাম থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তার বর্তমান কৃতিত্বের সম্মান জানাতে। বর্তমানে আমি শহরবাসী । নিজের মাতৃভূমির এই স্বীকৃতিদানে বড় আত্মতুষ্ট আমি। ছোটোবেলায় দু’বেলা পেটের ভাত জোটাতে মুখের রক্ত উঠে যেত বিধবা মায়ের। কতদিন যে, না খেয়ে স্কুলে গেছি । বই-এর অভাবে পড়তে পারিনি, রোদে কানধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। সব জানার পরে সহৃদয় মাষ্টারমশাই আর কিছু সহানুভূতিশীল প্রতিবেশীর দয়ায় উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ার খরচ চলেছে। কিন্তু বরাবর ভালো রেজাল্টের সুবাদে আর আমার বিনয়ী ভদ্র স্বভাবের জন্য সবাই ভালোবেসেই পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
জয়েন্টে ভালো র্যাঙ্ক করে ডাক্তারি পড়ব ঠিক করলাম। কিন্তু অত খরচ চালানো সম্ভব ছিলো না আমার গরীব মায়ের পক্ষে,কিন্তু ভাগ্য সবসময় সহায় আমার।তাই স্বেচ্ছাসেবীসংঘ,আর প্রফেসরদের নেকনজরে থাকার দরুন এম.বি.এস.-টা পাশ করে গেলাম। মা চলে গেলেন ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠনের ভিত গড়ে উঠছে দেখতে দেখতেই ,জীবনে ঐ স্বপ্নটুকুর সফল হওয়ার স্বাদ চোখে দেখলেন, চেখে দেখার সুযোগ পেলেন না। গ্ৰামের দিকে ফিরে তাকানোর ইচ্ছে বা প্রয়োজন সম্পূর্ণ বিলোপ হোলো। মা যাওয়ার পর দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম কিছুদিন, রঙ্গনা আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে অনাথ ছেলেটির প্রেমে কিভাবে পড়লো আজও রহস্য,তবে রঙ্গনার বাবা পরিপক্ক ব্যবসায়ী বুদ্ধি দিয়ে মেয়ের পছন্দের তারিফ করলেন। এককথায় মেনে নিলেন মেয়ের পছন্দকে, জানতেন পিছুটানহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষী এমন ডাক্তার পাত্রকে হাতছাড়া করাটা বোকামি হবে। মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির কষ্ট পেতে হবে না,তাঁর একমাত্র মেয়েকে কাছছাড়া করতে হবে না তার জন্য যেকোনো মূল্য দিতে তাঁর কুন্ঠা ছিলো না। আমিই বা কোন্ ধোওয়া তুলসীপাতা! রঙ্গনার সাথে নিজেকে জড়ানোর পিছনে কোনো হিসেব কাজ করেনি বললে নেহাতই মিথ্যে বলা হবে। শুধু রঙ্গনার প্রেম ছিল বিশুদ্ধ, সে আমার পাশে কল্যাণময়ীর হাত নিয়ে আজও সমানভাবে আমার সংসারকে গড়ে তুলছে। আমি শুধু সেখানে সুখের আস্বাদন করে আর নিজের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করে জীবন কাটাচ্ছি। স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডন থেকে এফ.আর.সি.এস করে ফিরে এসে রঙ্গনাকে বিয়ে করে শ্বশুরের যৌতুক দেওয়া সুসজ্জিত ফ্ল্যাটে যখন ঢুকলাম রঙ্গনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেছিল কারণ বুদ্ধিমতি রঙ্গনা ওর বাবাকে বুঝিয়েছিলো বাপেরবাড়িতে বর নিয়ে থাকলে তার এবং তার স্বামীর ফেসলস হবে আত্মীয় মহলে। সত্যি বলতে কি ,তখনও আমার কিছুটা আত্মসম্মান বোধ বেঁচেছিলো,শ্বশুরবাড়ির ভাত গলা দিয়ে নামত না এটা ঠিক। আমার জীবনের এই অধ্যায়টা স্বপ্নের মত,এতে আমার নিজের কোনো কৃতিত্ব নেই, শুধু নিজের কেরিয়ার গড়তে রঙ্গনাকে কখনও ব্যবহার করিনি,এটাই সান্ত্বনা। কলকাতার এক নামী বেসরকারি হসপিটালে যোগ দিলাম অ্যাটেনডিং ফিজিসিয়ান হিসেবে।
হঠাৎ একদিন হসপিটালে শটসার্কিট
হয়ে আগুন ধরে গেলো। বিবেকের দায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম মূমুর্ষু রোগীদের উদ্ধারকার্যে। কয়েকজন স্টাফের সাহায্যে সফল হলাম উদ্ধারকার্যে। সরকার থেকে সম্বর্ধনা দিয়ে সম্মান জানিয়েছিল,খবরের কাগজে কিছুদিন আমার চর্চা বড় করে ছাপানো হয়েছিল। এহেন কৃতিত্বে আপ্লুত জন্মভূমি নিজের ছেলেকে সম্মান জানাতে তৎপর আজ। আমিও দীর্ঘদিন মাটিছাড়া,ফেরার ইচ্ছে হয়েছে অনেকবার কিন্তু হেতু খুঁজে পাইনি বলে আসিনি। হঠাৎ এরকম হেতু পেয়ে ছুটে চলে এসেছি টানে। কিন্তু বসতবাড়িটাও আজ আর নেই। তাই পঞ্চায়েত প্রধানের ঘরে অতিথি হয়ে রাত্রিযাপন করে কাল অনুষ্ঠানের পর ফিরে যাবো ঠিক আছে।
নিজের জন্মস্থানে এসে মাটির টান কী,তা যেন মর্মে মর্মে অনুভব করলাম। অবহেলিত ভিটে আমাকে এক অমোঘ আকর্ষণে তার কাছে এনে ফেললো সন্ধ্যার মুখে। দূরে অস্তমিত সূর্যের সঙ্গে আমার ভাঙা হাড় জিরজিরে বসতবাড়ির কী যে মায়া বুঝতে পারলাম না,হু-হু করে চোখে জল এলো। বুঝলাম মায়ের নাড়ীর টান আর ভিটেমাটির অমোঘ আকর্ষণ দুনিয়ার সমস্ত প্রাপ্তিকে ক্ষণেকের জন্য ম্লান করে দিতে পারে। পাশে কার দাঁড়িয়ে থাকার আভাস পেয়ে চোখতুলে দেখলাম বৃদ্ধ বলরাম টুডু অত্যন্ত কুন্ঠিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। একসময় আমাদের জমিতে কাজ করত বলরাম খুড়ো,আমি মাঝিকাকা বলতাম, বীরভূমের আদিবাসী সম্প্রদায়ের নরনারীকে মাঝি বা মেঝেন বলে সম্বোধন করার রীতি আছে,সেইজন্যই মাঝিকাকা ডাকতাম।বুড়োকে আজ নিজের বাপের মতই আপন লাগলো। বললাম-
“কেমন আছো মাঝিকাকা?”
কাকা বললে,
“ঐ আছি বাবু।আপুনি কেমন আছো?
পাড়াগাঁয়ে সাঁওতালদের এই আপনি, তুমি মেশানো কথায় বড় আন্তরিকতার ছোঁয়া আছে। সেই আন্তরিক ব্যবহারে বড় তৃপ্ত হলাম। বললাম,
“ভালো আছি গো।”
বুড়ো ফোঁকলাদাঁতে হেসে বললে,
“বেঁচে থাকো,ব্যাটা।”
মনে পড়লো ওর ছেলে রবিন আমার সঙ্গে পড়ত। জিজ্ঞেস করলাম-
“কাকা,রবিন কেমন আছে?”
বুড়োর দিশেহারা চোখে জল উছলে পড়ল,তারপর চোখ মুছে নিভে আসা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপুনি কিছু শোনোনি,বাবু?”
দীর্ঘদিন এদের কারুর খবর নেওয়ার কল্পনাও যে করিনি একথা ঐ সরল বৃদ্ধকে বলা যায় না,তবু প্রসঙ্গটাকে একটু ঘুরিয়ে বললাম,
“অনেকদিন তো এদিকে আসা হয়নি,তাই এদিককার খবর তেমন পাইনি, কাকা। কেন কি হয়েছে রবিনের?”
বৃদ্ধ বললে-
“তা বটেক”
তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললে,
“আমোদপুর সুগারকলে কাজ করথ আমার ব্যাটা। ভালোই সংসার চলছিল বউ-ব্যাটা -লাতি – ব্যাটার মা টো কে লিয়ে। কিন্তু এখের গাড়ি আসা বন্ধ হয়ে গেলো ক’বছর আগে । চিনিকল বন্ধ হঁয়ে গ্যালো। ব্যাটা আমার দুটো প্যাটের ভাত জোটাতে কিই না করেছে । বাবুদের জমিতে ধান রুইথ, ঘরামির সঙ্গে যুগাড়ের কাজ করথ,গতর খাটিয়ে পাঁচপ্যাটের খাবার যুগাতে তার দম ছুটে যেথ ,বাবু। কিন্তু কোনোদিন কারুর কাছে হাত পাতথ লাই। অদ্দেষ্টে দুখ থাকলে,কে খন্ডাবে বাবু। সেই জোয়ান ব্যাটা আমার ঘড়ামির যুগাড়ের কাজ করতে গিয়ে ভারাছিঁড়ে পড়ে মরে গেলো । ওর জেবনের মোল ১০০০/- টাকায় ক’দিন আমরা খ্যেতে পেলাম। তারপর থ্যেকে বেধবা বউ লোকের ঘরে কাম করে আর আমি ছুটোখাটো কাজ করে কোনোরকমে দিন গুজারছি বাবু। বড় কষ্টে আছি।”
প্রত্যেকটা শব্দ আমাকে চাবুক মারছিল, কারণ ছোটোতে আমি যে কষ্ট করেছি তার থেকে অনেকবেশি কষ্ট ভোগ করছে রবিনের পরিবার। জীবনযুদ্ধে লড়াকু সৈনিকের মত অস্ত্রহীন হাতে যুঝে চলেছে নিরন্তর। সেখানে ভাগ্যলক্ষ্মীর কৃপাধন্য আমি এসেছি নিজের কৃতিত্বের সম্মান নিয়ে ধন্য করতে নিজের গ্ৰামকে।চরম ধিক্কার মনকে কিছুক্ষণ বিকল করে দিলো। বিনা উত্তরে ফিরে এলাম প্রধানের আতিথ্যে। রাত্রে প্রধানমশাই-এর ঘরে খাওয়ার আয়োজন দেখে চমৎকৃত হলেও খেতে পারলাম না ভালো করে। রবিনের বৃদ্ধ পিতার কাতর চাহনি প্রতিটা খাবারের স্বাদহরণ করে নিচ্ছিলো।
কয়েকজন মুমূর্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছি তাও অনেকের সাহায্য নিয়ে। যাদের সাহায্য নিয়েছি তাদের কেউ নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেনি, যেহেতু তারা খেটে খাওয়া শ্রেণির মানুষ তাই তাদের অনলস পরিশ্রম তাদের দায়িত্ব বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি, ভোরের আলোর সাথে সাথে যেন আমার ও চোখ ফুটলো। পঞ্চায়েত প্রদানকে ডেকে বললাম,
” আমার সম্বর্ধনার জন্য গ্ৰাম থেকে চাঁদা তুলে যে আয়োজন করছেন এখুনি বন্ধ করুন।”
ভদ্রলোক ত্রস্ত হয়ে পড়লেন, আমতা আমতা করে বললেন,
“স্যার , কিছু কি ভুল হয়েছে?”
বললাম,
” গ্ৰামে কত মানুষ খেতে পায় না। তাদের মধ্যে টাকাটা বিলিয়ে দিন। আর আমি এখানে একটা ফান্ড খুলবো মায়ের নামে, তাতে প্রত্যেকমাসে বড় অঙ্কের টাকা পাঠাবো। আমার গাঁয়ের কোনো গরীবের ঘরে যেন দু’মুঠো ভাতের অভাব নাহয় সেটা আপনারা দেখবেন।
After all charity begins at home…….”
//////////////////{সমাপ্ত}//////////////////////
Bidisa