ড.আশুতোষ বিশ্বাস

বুক রিভিউ

 কবিদের চিনিয়ে দেওয়ার বই 

তৈমুর খান 

একজন কবিকে চেনাতে পারেন একজন প্রকৃত আলোচক। কবিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ারও উদ্যোগ ও আয়োজনও তাঁরই। এরকমই একজন আলোচকের সাক্ষাৎ পেলাম ‘বাংলা কবিতার চলন বিচলন'(প্রথম প্রকাশ জুন ২০২২) নামক গ্রন্থে। ড.আশুতোষ বিশ্বাস একদিকে সম্পাদক, অধ্যাপক, কবি ও আলোচক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছেন। বাংলা কবিতায় পাঁচের দশক থেকে শূন্য দশক পর্যন্ত সময়কালের মধ্য থেকে তিনি বেশ কিছু নির্বাচিত কবিকে নিয়ে নিজস্ব উপলব্ধির আলোয় পাঠপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এই গ্রন্থে। সময়ের একটা দীর্ঘ প্রলম্বিত স্বর যেমন এই গ্রন্থে উঠে এসেছে, তেমনি ব্যক্তিভেদে কবিতার নানা বাঁকেরও পরিচয় দিয়েছেন। কবিদের নির্বাচনও করেছেন পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, আসাম ও ত্রিপুরার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সুতরাং ভৌগোলিক দিক থেকে এবং সময়ের দিক থেকেও একটা সেতু নির্মাণ করতে পেরেছেন বলা যায়। আলোচ্য কবিরা হলেন: বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরুণকুমার সরকার, শামসুর রাহমান, শঙ্খ ঘোষ, উৎপলকুমার বসু, হুমায়ুন আজাদ, রণজিৎ দাশ, সুবোধ সরকার, জহর সেনমজুমদার, চিরপ্রশান্ত বাগচী, বিভাস রায়চৌধুরী,ঋজুরেখ চক্রবর্তী, হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং  গৌরব চক্রবর্তী।

 ব্যক্তিগত পাঠসূত্র হলেও প্রতিটি কবির কবিতা নির্মাণের পর্যায়গুলি খুব সূক্ষ্মভাবে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাই বিষয় ভাবনা থেকে আঙ্গিক গঠন, আত্মচেতনা, ইতিহাসবোধ, সময় ও দ্রোহ, শব্দ ও চিত্রকল্পের ব্যবহার, মনন-প্রজ্ঞা ও অধুনান্তিক শব্দের প্রক্ষেপণও যথাযথ অনুধাবন করতে পেরেছেন। ফলে প্রতিটি আলোচনাতেই কবির জীবনদর্শন ও সৃষ্টির অভিমুখ উদ্ভাসিত হয়েছে। যেমন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে লিখেছেন: “হৃদয়ের গহীন সমুদ্রে ডুব দিয়ে তুলে আনা হৃদয়বৃত্তীয় লতাগুল্ম সরল অথচ গভীর— বহুদর্শনের অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক না হলে কোন্ মেঘে বৃষ্টি আছে যেমন বলা যায় না, তেমনি মানবমনের অতল সমুদ্রে ডুবসাঁতার দিয়ে তুলে আনা মণিমাণিক্য আগামী কবিতা পাঠকের কাছে আগামবাণী হয়েই থাকবে।”

 তখন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দ্রোহ ভাবনার অন্তরালে এই মানবজীবনের রসায়নকে আমরা খুঁজে পাই। তেমনি ভিন্নধারার কবি জহর সেনমজুমদার সম্পর্কেও লেখকের বক্তব্য হল: “মা মাটি মানুষের মধ্যে মানুষের সাথে চলতে চলতে এত প্রগাঢ় চিত্রকল্পনা এবং এত ঘনীভূত নাট্যধর্মিতা আমরা জহর সেনমজুমদার ছাড়া অন্যকোনো কবির কাছে এইভাবে ব্যবহৃত হতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।” প্রতীকবাদী এবং রূপকআশ্রয়ী কবি জহর সেনমজুমদার অনেক সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তাঁর অবচেতনার দরজা খুলে দেন কবিতায়। ফলে একটি ভিন্ন জগতেরই দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠেন তিনি। এমনি করেই হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কেও লেখকের বক্তব্য সুস্পষ্ট: “তিনি প্রতিদিন মানুষের শরীরের ঘামের গন্ধ পান, এদের সঙ্গেই তিনি মেলামেশা করেন, এদের সঙ্গে পরমাত্মীয়জ্ঞানে কথা বলেন, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, বেচাকেনা, বার্গেনিং, পচা মাছ নিয়ে মেছুরের সাথে দর কষাকষি করেন, সকলের মতো সবই করেন। তবুও তিনি কবি আমাদের অসংখ্য মানুষের ভিড়ে তিনি মানুষের মতোই তবুও কোথাও যেন পার্থক্য থেকে যায়—তিনি পরম মানুষ। তিনি কবি। তিনি পরমহংস।” অতি সাধারণের মধ্যে এই অসাধারণত্বকেই আবিষ্কার করেছেন কবির মধ্যে। প্রতিটি লেখার মধ্যেই এভাবেই কবিদের মূল্যায়ন ও দিক নির্দেশনা সমস্ত শ্রেণির পাঠকের কাছেই আগ্রহের সৃষ্টি করবে।

  লেখকের পরিশ্রম ও নিষ্ঠা এবং গভীরভাবে কবিদের পর্যবেক্ষণের প্রশংসা করতেই হয়। তবে ‘ভূমিকার মতো’ অংশটিতে এত কৃতজ্ঞতার বোঝা না রাখাই ভালো ছিল। গ্রন্থের নামকরণে ‘কয়েকজন কবির কবিতার  চলন বিচলন’ করাই যুক্তিযুক্ত হত।

ড.আশুতোষ বিশ্বাস

 বাংলা কবিতার চলন বিচলন: ড.আশুতোষ বিশ্বাস,  সাঁঝবাতি প্রকাশন, মশিয়াড়া, বাঁকুড়া-৭২২১২১, প্রচ্ছদ দয়াময় বন্দ্যোপাধ্যায়, মূল্য ৩০০ টাকা।

আলোচক ড. তৈমুর খান

আলোচক ড. তৈমুর খান

Leave a Reply