তিনজন অনালোচিত কবির কথা
প্রজ্ঞাময় ব্রহ্মজীবনের ধারক ও হৃদয়তান্ত্রিক বর্ণমালার তিন কবি
তৈমুর খান
তরুণ বয়সে সাহিত্যচর্চার ঝোঁক অনেকেরই থাকে, তখন বোঝা যায় না ভবিষ্যতেও তা চালিয়ে যেতে পারবে কিনা। এর জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়। বিশেষ করে সংসার জীবনে প্রবেশের পর জীবন-জীবিকার সংগ্রামের মধ্যে থেকে সাহিত্যচর্চার মতো কাজকে সে টিকিয়ে রাখতে পারে কিনা সেটাই দেখার। নয়ের দশকে আমার সময়কালে এরকমই অনেক তরুণকে সাহিত্য চর্চা করতে দেখেছিলাম। পরবর্তীকালে তাঁরা অধিকাংশই সাহিত্যের পথ পরিত্যাগ করে বর্তমানে ভিন্ন পথের যাত্রী। তাঁদের বাড়িঘর চকচকে হয়েছে। যানবাহনও কারও কারও দু’চাকা-চারচাকা। কারও কারও শোরুম, লজ-রেস্টুরেন্ট কিংবা রোগী দেখা চেম্বার। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ বড়বাবু-মেজবাবু, উকিল-মোক্তার, প্রফেসর-মাস্টার ইত্যাদিও আছে। রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’, ‘বাঁশি’, ‘দুই বিঘা জমি’, ‘পুরাতন ভৃত্য’ এবং নজরুলের ‘বিদ্রোহী’, ‘আমার কৈফিয়ৎ’, ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘জাতের বজ্জাতি’, জীবনানন্দ দাশের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’, ‘বনলতা সেন’, ‘বোধ’ ইত্যাদি কবিতা আবৃত্তি করা ছাত্ররাও আর কবিতার অঙ্গনে নেই। সবাই সুকান্তের কবিতার মতোই মনে করেছে:’আরো বেশি টাকা চাই/আরো বেশি ভালো হয়ে থাকা চাই।’
কিন্তু এর ব্যতিক্রমী তিনজন কবিকে পেয়েছিলাম, যাঁরা ছিল একান্ত মুখচোরা, লাজুক, কথা কম বলা ছাত্র। আজও তাঁরা থেকে গেছে সাহিত্যচর্চায়। তথাকথিত মূল স্রোতের বাইরে নিজস্ব বৃত্তের সীমানায়। দীর্ঘদিন চর্চায় থাকলেও আড়ম্বর করে, আস্ফালন করে আত্মপ্রচার করেনি। বরং নিঃশব্দচারী কৃচ্ছ্র সাধক হয়েই থেকে গেছে আত্মগোপন করে। এঁদের কথা বলতেই এই প্রবন্ধের আয়োজন।
এই তিনজন কবি হলেন :
১, আব্দুল বাসার খান
২, অনিমেষ মণ্ডল
৩, বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
১, আব্দুল বাসার খান
বাসার খান বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের একটি অখ্যাত গ্রাম পানিসাইলের বাসিন্দা। জন্মেছেন ১৯৬৬ সালে। বিজ্ঞানের ছাত্র। রামপুরহাট কলেজ থেকে বি এস সি বায়ো পাশ করে টিউশান পড়াটাকেই জীবিকা অর্জনের জন্য বেছে নিয়েছেন। সদ্য পাস করা কলেজের ছাত্র অবস্থাতেই লিখেছেন ‘রাতের যাত্রী’ নামে একটি উপন্যাস। মফস্সল থেকে সাদামাটা মলাটে উপন্যাসটি প্রকাশ হলে এই এলাকায় একটা দারুণ হইচই শুরু হয়ে যায়। ছাত্র অবস্থাতেই বাসারকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। চারপাঁচটি গ্রাম মিলে পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে রিপোর্ট করা হয় বইটি সম্পর্কে নানা অভিযোগ তুলে।
কী ছিল উপন্যাসটিতে?
গ্রামের এক মাতব্বর ধনাঢ্য ব্যক্তি, গ্রামের অন্যান্য গরিব অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদের উঠতি যুবতী মেয়েদের সামান্য অর্থের বিনিময়ে যৌন উপভোগের বস্তুতে পরিণত করত। দিনেরাতে যখন ইচ্ছা তখনই এই কাজে প্রবৃত্ত হত। কেউ প্রতিবাদ করতে পারত না। একদল গুণ্ডাবাহিনী তার সঙ্গ দিত। তাই ভয়ে কেউ মুখ খুলত না। বাসার প্রথম এই মৌচাকে ঢিল ছোঁড়ে। সেই ঢিল অব্যর্থ হয়ে সমস্ত মৌচাককে আন্দোলিত করে দেয়। এলাকার মানুষ এই মাতব্বরের চরিত্রহীনতার পরিচয় পেয়ে যায়। এমনকী কচিকাঁচারাও বইটির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। স্থানীয় বুক স্টলগুলি থেকে বইটির কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। যত প্রচার হয়, লেখকের প্রতি আক্রোশও তত বৃদ্ধি পায়। সামান্য একটি ছাত্র, যার অর্থ বল নেই, লোকবল নেই, সামাজিক কোনো মর্যাদা নেই সেই কিনা এমন বই লিখতে পারে! গুণ্ডাবাহিনী প্রস্তুত হয়ে যায় তাঁকে মারার জন্য। প্রাণভয়ে বাসার পালিয়ে যায় এক মাসতুতো পুলিশ দাদার বাড়িতে। সেখানে আত্মগোপনেই থাকে। অবশেষে প্রধানের সহায়তায় মুচলেকা লিখে দিতে হয় সমস্ত বই পুড়িয়ে ফেলে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলে তবেই রেহাই করা হবে। এরকমই শর্তে রাজি হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। বহু কষ্টে সমস্ত বই সংগ্রহ করে প্রকাশ্য আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে তারপর সেই যাত্রায় রক্ষা পায়। কিন্তু ততদিনে এক বছর কেটে যায়। বাসার পরবর্তী সময়ে আর কোনো উপন্যাস লেখার সাহস পায় না, ফিরে আসে কবিতায়।
১, বাসারের লেখা কয়েকটি বই:
৩,রাতের যাত্রী – ১৯৮৯(উপন্যাস)
৪,ধূপকাঠি- ২০০১(কাব্য)
৫,ঊষালগ্ন জমি -২০১১(কাব্য)
৬,নীল ঝর্ণা হলুদ সাঁকো-২০২০ (কাব্য)
৯০ দশকের প্রথম দিকেই ‘বিকল্প’ পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর প্রথম কবিতা। এখানেই ঘরের দরজায় গোবর ছড়ানো আর নিকানো উঠোন চোখে পড়ে। বাসার লিখে ‘মাড়ুলি দেওয়া ভোর’। এই ভোরই তাঁর কাব্যের ভোর হয়ে আসে। তারপর ‘প্রত্যাবর্তন’ নামক কবিতায় লেখে:
“জীবনের ব্যস্ত হাটে
পৃথিবীর জঞ্জাল জড়ানো এত পথ
চলন ছেঁড়া অমানিশা কফিন ঢাকা লাশের মতো
কোনো সাড়া নেই; তবু হলুদ সাঁকো পেরিয়ে যেতেই হবে।”
এই হলুদ সাঁকো পেরিয়ে যুগোত্তীর্ণ প্রতিভা নিয়েই তিনি অগ্রসর হয়েছেন। লিখেছেন ‘নীল ঝর্ণা হলুদ সাঁকো’। আত্মদর্শনের কবিতায় পাঠককে একান্ত অভিনিবেশ দান করেছেন। বুঝিয়েছেন জীবন একটা মহাকাল প্রবাহের সামান্য ড্যাশ মাত্র। কেমন এই ড্যাশ?
একজন বিখ্যাত আমেরিকান সংগীতশিল্পী ও দার্শনিক কেভিন ওয়েলচ(১৯৫৫) বললেন:’There’ll be two dates on your tombstone and all your friends will read ’em but all that’s gonna matter is that little dash between ’em.’ ~ Kevin Welch
অর্থাৎ আপনার সমাধির পাথরে দুটি তারিখ থাকবে এবং আপনার সমস্ত বন্ধুরা এগুলি পড়বে তবে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হ’ল তাদের মধ্যে সামান্য ড্যাশ।
এই দুটি তারিখ জন্মের ও মৃত্যুর আর তার মাঝখানে যে সামান্য ড্যাশ সেটুকুই জীবন।আব্দুল বাসার খানের কাব্যগ্রন্থখানিতে নীল ঝর্ণার পাশে জীবনের উৎসকে খুঁজে পেলাম। হলুদ সাঁকোর পাশে জীবনের সমাধিস্থ সমাপ্তি ঘোষণাকে উপলব্ধি করলাম। গ্রন্থের ‘প্রাসঙ্গিক: উঠান আলপনা’য় একথার স্পষ্টতা প্রতিধ্বনিত করেছেন। নীল ঝর্ণায় জেগে উঠেছে ‘আমি’ সত্তা= নিরন্তর সূর্য, অক্ষতল। অর্থাৎ পার্থিব জীবনের শরীর, যখন উপলব্ধি আর প্রবৃত্তির জাগরণে সমৃদ্ধ।
তারপর ‘তবু’ অব্যয় ব্যবহার করে অন্ধকারে গমন এবং শূন্যতার বুক—সম্মোহনে দীর্ঘপথের অন্বেষণ। কবি লিখেছেন: ‘অন্ধকারও ছুঁয়েছে আমাকে/ শূন্য বুক, দীর্ঘ পথরেখা—’
তারপর একটি ক্রিয়া ‘চলা’ অর্থাৎ জীবনধারায় প্রবহমান হওয়া। কবি লিখেছেন: ‘এই চলা’….
সবশেষে দুটি প্রশ্নসূচক শব্দ:
‘কেন?’ এবং ‘কার ডাকে?’
এই দুটি শব্দের মাঝখানেই দিয়েছেন ড্যাশ।
এই ড্যাশেই জীবনের পরিমাপটুকু, চলাটুকু, বেঁচে থাকাটুকু থেকে যায়। যদিও জীবন নাথিংনেসেই সমর্পিত। কবি ব্যাখ্যা করে লিখেছেন… ‘অন্তরালে ছুঁয়ে থাকা স্বপ্নবেলা। কোনো রঙ নেই, অথচ বিচিত্র বিস্ময়। আমি হেঁটে চলেছি, কোথাও পৌঁছাতে পারিনি।’
একটা তারিখ থেকে আরেকটা তারিখের দিকে হেঁটে যাওয়া যায়, কিন্তু পৌঁছানো যায় না। তাই কবিও পৌঁছাতে পারেননি, অথচ তিনি হেঁটে চলেছেন। তাঁর হাঁটার শেষ নেই। হাঁটতে হাঁটতেই দেখেছেন: ছাদহীন শূন্য মাঠ। নন্দিনীরা আঁচল ওড়াচ্ছে। চারু-নীলের ছায়া কপাট খুলে যাচ্ছে। একে একে ভেসে যাচ্ছে সবকিছু। যদিও কিছুই ছিল না। তবু ভেসে যাচ্ছে। কবি জিজ্ঞেস করেছেন: কী ভেসে যাচ্ছে?
কবি উত্তর পেয়েছেন: মায়া ভেসে যাচ্ছে। যা শূন্যতারই অর্থাৎ এম্পটিনেসেরই প্রজ্ঞা। এইখানেই জীবনের শেষ তারিখটি স্তব্ধ হয়ে যায়। তাই কবি লিখেছেন:
‘সুদূর পিয়াসী মন-পাখি
দৃশ্য শূন্যতার অনুভবে
এসো, সাঁকোটি পেরোই
পেরোতে পেরোতে নীলাভ সিক্ততায়
জীবন-আকাশ মাখি’
এই ‘জীবন-আকাশ’ অনন্তেরই উচ্চারণ ও বিকাশ। সম্পূর্ণরূপে নাথিংনেসে পৌঁছানোরই প্রাগভাষা। উপলব্ধির চূড়ান্ত রূপই অসীমতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে পারে। এই কারণেই বিখ্যাত কবি উইলিয়াম ব্লেক(১৭৫৭-১৮২৭) বলেছেন:’If the doors of perception were cleansed every thing would appear to man as it is, Infinite. For man has closed himself up, till he sees all things thro’ narrow chinks of his cavern.’
(William Blake, The Marriage of Heaven and Hell: In Full Color)
অর্থাৎ উপলব্ধির দ্বার শুদ্ধ হলে প্রতিটি জিনিসই মানুষের কাছে দেখা যেত, অসীম। কারণ মানুষ নিজেকে বন্ধ করে রেখেছে, যতক্ষণ না সে তার গুহার সরু চিকন দিয়ে সব কিছু দেখতে পায়। আব্দুল বাসার খানও সেই অসীমতায় পৌঁছতে পেরেছেন। প্রেম থেকে যাত্রা শুরু অর্থাৎ ছোট্ট ড্যাশ অতিক্রম করার প্রয়াস। তারপর সবই অনন্তের আকাশে সমর্পিত। কয়েক টুকরো কবিতার উদ্ধৃতি এই প্রসঙ্গেই প্রয়োজন হয়ে পড়ে:
‘আকাশ চিঠির সব অক্ষর
এখনো রেখেছি জমা,
রাত্রি দুয়ার খুলে ফিরে এসো
প্রভাতের প্রিয়তমা।’
‘আকাশ চিঠি’ কথাটি ইঙ্গিতপূর্ণ অনন্তের প্রতীকী অভীপ্সা। আর যেখানে অন্ধকারের দরজায় প্রভাতের অপেক্ষা। এই প্রসঙ্গেই বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সোরিন সেরিন(১৯৬৬) বলেছিলেন:’Only in the eyes of love you can find infinity.’
(Sorin Cerin, Wisdom Collection: The Book of Wisdom)
অর্থাৎ শুধু ভালোবাসার চোখেই তুমি অনন্ত খুঁজে পাবে। ভালোবাসা কখনো আশ্চর্য জাদুকর হয়ে উড়েছে কবিতাগুলিতে। তাদের সম্মোহনী ডানাও বিস্তার করেছে। ড্যাশের মধ্যেই অবস্থান করেই অনন্তের এই প্রাজ্ঞ দর্শনের বিক্রিয়া কবির মধ্যেও ঘটে চলেছে। তাই অন্য একটি কবিতায় লিখেছেন:
‘সব কবরের ছায়া থেকে তুলে আনা প্রশ্নের
বৈদেহী উত্তরগুলো
যতই সুন্দর হোক
আমি আর কাফন গল্পের শুভ্রতা মাখবো না।’
অনন্ত কখনোই তার ক্ষুদ্রত্বকে গ্রহণ করে সীমানা নির্দেশ করে না। সর্বদা তা অসীমতায় পর্যবসিত হয়। আমেরিকান ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার ফিলিপ কে ডিক(১৯২৮-১৯৮২) এই কারণেই বলেছিলেন:’The problem with introspection is that it has no end.’
(Philip K. Dick)
অর্থাৎ আত্মদর্শনের সমস্যা হল এর কোনো শেষ নেই। এই আত্মদর্শন কবির জীবন যাপনের মুহূর্তগুলোতে রূপান্তর ঘটে চলেছে। যে জনস্রোত তিনি দেখেছেন তা ‘বুধনি বুড়ি’ হোক, কিংবা চৈত্র আষাঢ় শ্রাবণ অথবা শীতকাল হোক, অথবা মধুর মায়ের গর্ভবতী গাভীর গল্প হোক, অথবা সুতপার শাশুড়ির ভারি বয়সের প্রেম হোক, কিংবা বাড়ির ছাদের বিকেল হোক—সবই অনন্তের কাছে ধ্বংস হয়ে যায়। হাতের তালুতে অনন্ত এসে বসত করে। মাটিও অনন্তের প্রচ্ছদ। আকাশ অনন্তের পৃষ্ঠা। নদী অনন্তের প্রবাহ। ঘামশরীর নোনাগন্ধ অনন্তের উপলব্ধি। কবিতায় সে কথাই বলেছেন বারবার:
‘যা ঝরেছে অনিবার নীলিমা প্রশ্রয়ে
জুড়েছে হলুদ সাঁকো
সীমাহীন জাগরণ ছায়ে,
আমিও কালের খামে
প্রিয় অভীপ্সার নামে
নীল-ঘট একান্তে ভাসাই….’
সেই ‘নীলিমা প্রশ্রয়’ নীল ঝর্ণারই প্রকারান্তর, যাতে রোদের বহতা স্রোত মেখে কবি হেঁটে চলেন। তাঁর ড্যাশ তাঁকে নিয়ে চলে স্বপ্ন-মধুপুরের দিকে। জীবনরেখার অজস্র মোচড়ে তরঙ্গের ছায়া সিঁড়ি তাকে পৌঁছে দেয় অনন্তের মহা পৃথিবীতে। সেখানে কবির উপলব্ধি হয়:
‘নাগালবিহীন ঊর্ধ্বলোক, নক্ষত্রকথা।’ আত্মদর্শন চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। আব্দুল বাসার খান তখন অনন্তের বাসার হয়ে ছিটকে পড়েন। একজন শক্তিশালী কবি মাত্র কয়েকটি কাব্য প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছেন। প্রকৃত বিচারে তা যে কত বিস্ময়কর এবং বৃহৎ তা বাংলা কবিতার পাঠককে একদিন ভাবতে হবে।

২, অনিমেষ মণ্ডল
অনিমেষ মণ্ডল জন্মগ্রহণ করেছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জে ১৯৭৫ সালে। পড়াশোনা করেছিলেন বিজ্ঞান বিভাগে পদার্থবিদ্যায় অনার্স নিয়ে সাঁইথিয়া অভিনন্দন কলেজে। পরে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও অর্জন করেন। বর্তমানে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় কাটোয়া থেকে প্রকাশিত ‘তথ্যদর্পণ’ পত্রিকায় ১৯৮৯ সালে। তারপর থেকেই লেখায় ছেদ পড়েনি। অনেকগুলো বইও বেরিয়েছে, কিন্তু আশ্চর্য উদাসীনতায় বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে তিনি আজও অচ্ছুত হয়ে আছেন। পরিচয় ঘটেনি উল্লেখযোগ্য সম্পাদকের সঙ্গেও। একটা বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে ৯০ দশক থেকে তিনি পথ হাঁটছেন, অথচ আজও অচেনা। আসুন তাঁর রচিত বইপত্রের তালিকাটা দেখে নিই:
১,ভারতবর্ষ কোনোদিন জানবে না (১৯৯৬)
২,শীতকালীন একটি সফর (২০০২)
৩,আমার কোনো প্রতিভা নেই (২০০৪)
৪, একটি ভোর ও রুগ্ন পালকের কবিতা (২০০৭)
৫,অনন্ত লুব্ধক (২০১০)
৬,নিঃসঙ্গ বাতিঘর (২০১২)
৭,ঈশ্বরের ছায়া (২০১৬)
৮,মেঘবৃষ্টির চিঠি (২০১৭)
৯,গাছের পাতারা জানে (২০১৮)
১০,বিমূর্ত একতারা (২০১৯)
১১,বাকিটুকু চরাচর (২০২০)
গদ্যের বই
১,অনিশ্চিত মেঘ ও বালুচরের খেলা (২০১৯)
২, ব্রহ্মাণ্ডের আশ্চর্য তটভূমি (২০২২)
অনিমেষ জীবন ও অনন্তের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাঁর চেতনাকে প্রসারিত করেছেন। তাঁর প্রশ্ন যেমন ‘কে আমি’? তাঁর উত্তরও তেমনি ‘আমি অনন্ত’। এই অনন্ত বৃহৎ, বিস্ময়কর, শাশ্বত; কিন্তু ‘আমি’র মধ্যে তার প্রকাশ কেন? এ কথার উত্তর ভাবতে গিয়েই অনিমেষের বিজ্ঞানচেতনা ক্রমশ দার্শনিক চেতনার দিকে অগ্রসর হয়েছে। আর সেখানেই শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের ব্রহ্মময় পরাজীবনের হাতছানি তাঁকে আকর্ষণ করেছে। তাই প্রাত্যহিক জীবনের ধুলোমলিন জরাজীর্ণ কদর্য রূপের মধ্যেও আত্মসম্মোহিত এক বিভোরতা তাঁর কবিতার মধ্যে পাওয়া যায়। সাংকেতিক ভাষা হয়ে ওঠে মুক্ত গদ্যের চালে লেখা কবিতাগুলি। কাব্যের ভূমিকায় তিনি লেখেন: “আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে বাস করে নির্জনতাপ্রিয় অন্য এক আমি। সমস্ত দিনের কোলাহল পেরিয়ে, ব্যক্তিগত জীবনের সব চাওয়া পাওয়াকে তুচ্ছ করে সে একবার নিজস্ব প্রান্তরের সামনে নতজানু হয়ে বসতে চায়। তখন এক ধূলিমলিন মানবজীবনের সম্মুখে যেটুকু পড়ে থাকে তার সবটুকু চরাচর। কবিতা সেই আনন্দময় উড়ান যা আমাদের চরাচরকে আরও খানিকটা পরিব্যাপ্ত করে।” সেখানেই আশ্চর্য সরলতা, অনস্বাদিত মুক্তি লাভ করা সম্ভব। তাঁর কাছে কবিতা স্বাভাবিকভাবেই আনন্দ ও মুক্তির মন্ত্র।
নিজেকে বিস্তৃত করার এক প্রাজ্ঞ অনুভব কাব্যগুলিতে ছড়িয়ে আছে।
অনিমেষ প্রত্নজীবনের স্বতশ্চল বারান্দা থেকে খোঁজ করেন তাঁর আবহমান সত্তাকে । সেখানে কখনও দ্রাবিড় আলো পড়ে, কখনও নিষিক্ত হয় প্রবৃত্তির অমোঘ টান। ‘গাছের পাতারা জানে’ কাব্যে লিখেছেন:
“রোহিনী নক্ষত্রের শান্ত জল
আর আমি সেই নক্ষত্রবীথিকার নিচে শুয়ে
গতজন্মের কথা ভেবেছি
আগামী জন্মের মায়ের কথাও ভেবেছি”
এই ভাবনার ব্যাপ্তি কখনও ফুরোয় না। তাঁর যাপিত জীবনের ক্ষণগুলি “ছোটবেলার জোনাকি” হয়ে ঘুরতে থাকে। পাখিদের ভাষা পায় । পাতার জালিকার লেখায় উচ্চারিত হয়।
খুব সংযমী মহাশূন্যের ভেতর এক উদাস বৈরাগ্যের তীর্থে কবি তাঁর সংরাগলিপির বারোমাস্যা লিখে চলেন। খুব আন্তরিক আর সুগভীর প্রত্যয়ের বন্দনা হয়ে ওঠে কবিতাগুলি। অতীতচারী আত্মচর কবির স্মৃতির সরণি কখনো লণ্ঠনের আলোয়, কখনো জোনাকির, কখনো বাঁশবনের শনশন আওয়াজে ভেসে ওঠে। ‘বাকিটুকু চরাচর কাব্যে’ এই প্রত্নশেকড়ের সংযোগ আরও গভীরে বিস্তৃতি লাভ করে:
“দূরে শূন্যের গহ্বর থেকে
নেমে আসছে মেঘের আশ্চর্য পালক
ওই পালকই একদিন আমার
আদিম মাতার পোশাক ছিল”
এখানে সেই ব্রহ্মজীবনের উৎসে আমাদের নিয়ে গেছেন কবি—যেখানে সৃষ্টি,স্থিতি ও লয় বিরাজ করে। যেখানে ধ্বংস ও পুনরুত্থানের আবর্তন চলতে থাকে। নিজেকে বিস্তৃতির অসাধারণ প্রজ্ঞায় যেমন তাঁর ‘বিমূর্ত একতারা’ বেজে উঠে, তেমনি ‘অনন্ত লুব্ধক’ কাব্যে সুজাতার মেয়েকে আহ্বান জানান বৌদ্ধিক হওয়ার জন্য:
“তুমি সেই বুদ্ধের সুজাতার মেয়ে
আমাদের মর্মর পৃথিবীতে এসো
গুম্ফার অবিরাম শ্লোক হয়ে
ভেসে ভেসে এসো
তোমাকে প্রণাম করে বৌদ্ধিক হব
মন্ত্রের লাবণ্যে নীলিমায় ভেসে যাব”
এখানেই ধ্যানতন্ময় অনিমেষের একান্ত আত্মঅভিনিবেশকে উপলব্ধি করা যায়। তাঁর প্রজ্ঞায় ব্রহ্মতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, জীবনতত্ত্ব যে প্রাচুর্যময় উপলব্ধির অনুজ্ঞায় স্ফুরিত হতে চেয়েছে—বাংলা সাহিত্যের ক’জন পাঠক খোঁজ রাখেন? ‘একটি ভোর ও রুগ্ন পালক’ কাব্যে তিনি লিখেছেন:
“আমার শিরা-উপশিরায় পঞ্চনদীর জল বয়ে যায়”
এই বোধ একজন প্রকৃত সাধকেরই হওয়া সম্ভব। যে জীবন বাউলের, যে জীবন রোদ্দুরের, যে জীবন রাত্রির—সেই জীবন জলেরও, বাতাসেরও, মেঘেরও এবং আগুনেরও। অনিমেষ পঞ্চভূতের সমন্বয়ী চেতনায় নিজেকে বিলীন করেছেন, আবার প্রাণময় ব্রহ্মায় উত্থান ঘটিয়েছেন।
বেঁচে থাকাই তাঁর কাছে এক তপস্যা। আর এই তপস্যাই মোক্ষলাভের উপায়। আর এই মোক্ষই তো প্রেম। নির্মেদ, তীক্ষ্ণ, তীব্র রহস্যে মোচড় দেওয়া সহজিয়া বোধের কবিতাগুলিতে জীবনের পরিধি কতদূর ব্যাপ্ত হতে পারে কয়েকটি চেনা শব্দের ব্যবহারে শাশ্বতকালীন অনুভূতির প্রকাশে অনিমেষ তা জানিয়ে দেন। বিখ্যাত লেখক রায় টি বেনেট, দ্য লাইট ইন হার্টএ এই উপলব্ধির কথাই ব্যক্ত করেছেন:
“Believe in your heart that you’re meant to live a life full of passion, purpose, magic and miracles. “
(Roy T. Bennett, The Light in the Heart)
অর্থাৎ আপনার হৃদয়ে বিশ্বাস করুন যে আপনি আবেগ, উদ্দেশ্য, যাদু এবং অলৌকিকতায় পূর্ণ জীবনযাপন করতে চাইছেন। কথাগুলি সম্পূর্ণভাবে মিলে যায় কবি অনিমেষ মণ্ডলের কবিতা সম্পর্কে।
অনিমেষের কবিতায় আছে সেই সচল চিত্রকল্পের সঙ্গে ঐতিহাসিক অন্বয় যা সত্তার আদি প্রেক্ষাপট থেকে কোনো দ্রাবিড় নিয়তির পর্যায়ক্রমিক গ্রন্থনায় থাকে। তাঁর কাছে ভারতবর্ষ শুধু দেশই নয়, কবির আশ্রয় এবং হৃদয়ও। এখানেই মানুষ ও মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তিরসায়নকে অনিমেষ সূত্রবদ্ধ করেছেন। কখনো নিঃস্বতার নির্মম কষাঘাতে, কখনো আত্মিক দৈনের চরম হাহাকারে। বাস্তবিক কবিতাগুলিকে সেই প্রাচীন ঐতিহ্যের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। তাই শূন্যতা, সূর্য, কুয়াশা, জ্যোৎস্না তাঁর কবিতায় কোনো মায়াময় ঈশ্বর নয়, নশ্বর মানবসত্তার অবিনশ্বর আবেদন ও আদি প্রবৃত্তির সংকলন।
৩,বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
বীরভূম জেলার রামপুরহাট সংলগ্ন আখিরা গ্রামে জন্ম বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৯৭৩ সালে। স্কুল জীবন থেকেই তাঁর বৈচিত্র্যময় প্রতিভার স্ফুরণ ঘটতে থাকে। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কলকাতায় মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে গিয়েও বুঝতে পারেন ‘এসব আমার কর্ম নয়’। যে হাতে তুলি ধরে তিনি ছবি আঁকেন, যে হাতে কলম ধরে কবিতা রচনা করেন, সে হাতে তিনি ছুরি কাঁচি নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে যেতে পারবেন না। তাই ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়েই ভর্তি হন কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে। অসম্ভব ভালো রেজাল্ট নিয়েই সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। ইতিমধ্যে নব্বই দশকের মাঝের দিকেই ‘ঘুম’ নামে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা লিখে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণও করেছেন। কিন্তু দ্বিতীয় বার আর কবিতা লেখেননি। ভালো রেজাল্ট থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হননি। অস্থির মন নিয়েই ফিরে এসেছেন বাড়িতে। একের পর এক ছবি এঁকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। একের পর এক কবিতা,গল্প, নাটক লিখে চলেছেন। কখনো সাংবাদিকতা, কখনো অভিনয়, কখনো এ্যাংকারিংও করে চলেছেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে ইতিমধ্যেই পিতৃহারা হয়ে সংসারে অভিভাবকহীন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। লেখালেখি প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। একসময় ‘কফিহাউস’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েও এবং ৯০ দশকের নামকরা কবিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। যে বাপ্পাদিত্য চেষ্টা করলে সাহিত্য জগতে কলকাতাকে শাসন করতে পারতেন, সেই বাপ্পাদিত্য সেসব অবহেলা করে ঠেলে দিয়েছেন। শক্তি-সুনীলের যেমন স্নেহধন্য হয়েছিলেন, তেমনি তৎকালীন ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কাছাকাছি গিয়েও কোনো সুযোগ গ্রহণ করেননি। আজ এই বাপ্পাদিত্যের কথাই বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে বলতে চাইছি।
বাপ্পাদিত্য সর্বসাকুল্যে চারটি কাব্যগ্রন্থ ও একটি গদ্যের বই প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সেগুলি কোনোটিই তেমনভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছায়নি। বইগুলি হল:
১,স্তব্ধ শব সবুজ হ’তে চায় (২০০৪)
২,সময়ের ক্যানভাস (২০১০)
৩,হৃদয়তান্ত্রিক বর্ণমালা (২০২১)
৪,নৈঃশব্দ্যে নতজানু (২০২২)
গদ্য বই
যে জন আছে মাঝখানে (২০১৫)
বাপ্পাদিত্য নিজের সম্পর্কে লিখেছেন: “দীর্ঘ সময় ধরে আমি হেঁটে চলেছি কবিতার পথে। সে এক অন্ধকারময় দিশাহীন সময়—পড়াশোনার পাঠ শেষ করে বেকারের পোশাক পরা, জীবন-জীবিকার যুদ্ধে বারবার ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি রুগ্ন,শীর্ণ বাবাকে বাঁচিয়ে রাখার আমরণ প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে ভেসে গেছে স্বপ্ন, ভেসে গেছে প্রেম। সেই অন্তর্বর্তী সময়ে আমি শান্তি খোঁজার চেষ্টা করেছি, আর সকলের অন্তরালে, বিভিন্ন কাজের অন্তরায়ে নিঃশব্দে প্রস্তুত করেছি আমার এগিয়ে চলার পথ,নতজানু হয়ে সাজিয়ে চলেছি হৃদয় উৎসারিত সত্য অক্ষরমালা। তারপর কোনো একদিন সাহিত্যের চেনা গন্ধকে সঙ্গী করে ফিরে এসেছি চেনা ছন্দের ময়দানে। বিগত সময় নিয়ে আর কোনো অনুযোগ নেই, কারণ কবিতার ছত্রে ছত্রে আমি খুঁজে নিয়েছি আমারি মুক্তি। এই অনুভূতিগুলো প্রকাশ করা ছাড়া আমার আর কোনো বিকল্প ছিল না। তাই নিঃশব্দে শূন্যতার কাছে নতজানু হয়ে নিবেদন করছি আমার গোপন পাপগুলি।”
বাপ্পাদিত্য কী লিখতেন, কেন লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন, কেন আবার ফিরে এসেছেন, কী তাঁর গোপন পাপ—সব উত্তরগুলিই আমরা তাঁর জীবন থেকে পাই। বাপ্পাদিত্য কবিতায় জীবনকে লিখতে চেয়েছেন, যে জীবন আধখাওয়া সিগারেটের মতো অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিলে ধোঁয়া হয়ে নিভে যায়। যে জীবন গান গাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও গান গাইতে পারে না। যে জীবন বসন্ত এলেও ফুল ফোটাতে পারে না। বাপ্পাদিত্যের এই কঠোর কঠিন পাপের জীবন যা তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সেই নির্বাসন থেকে বহু কষ্টে তিনি ফিরে আসতে চেয়েছেন। ‘নৈঃশব্দ্যে নতজানু’ কাব্যে লিখেছেন:
“বিরহবিধুর একাকিত্বের বেদনায় তবু স্বপ্ন ছিল
অনিকেত সন্ধ্যায় স্মৃতি একরাশ
বয়ে আনে উত্তুরে বাতাস, নগ্ন চরাচরের
সেই একইভাবে ক্লান্ত রাত্রিগুলি যেন ছায়ামুখ
বিনিদ্
দৃশ্য বদলায়, দৃশ্যান্তরে চরিত্রও সব বদলে যায়
একা রাত পড়ে রয় অবিকৃত আঁধার হয়ে
শব্দগুলি পাক খায় মাথার ভিতর,ব্যর্থ প্রেমিকের
বিনিদ্র সময়ের গর্ভ হতে জন্ম নেয় অশেষ কবিতার দল”
এই বিনিদ্র সময় একান্ত জীবনেরই সময়। জীবনের অন্তর্গত অভিঘাতগুলি সর্বদাই বিপর্যস্ত করে তোলে। ক্লান্ত বিপন্ন এই জীবন তখন কবিতায় তার দীর্ঘশ্বাস রেখে যায়। সেই দীর্ঘশ্বাসই বাপ্পার কবিতায় শুনতে পাই। আমরা জানি লিওনার্দো দা ভিঞ্চির কথাটি:
“Tears come from the heart and not from the brain.”
অর্থাৎ অশ্রু হৃদয় থেকে আসে মস্তিষ্ক থেকে নয়। বাপ্পাদিত্য তাই কাব্যেরও নাম রাখেন ‘হৃদয়তান্ত্রিক বর্ণমালা’—যেখানে হৃদয়ই শেষ কথা।
আমাদের তরুণ প্রজন্মের যুবকেরা এখনো আবেগের চর্চা করে, শব্দে শব্দে বিয়া দেয়, অক্ষরকর্মী হয়ে সাহিত্য শিল্পের ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে। তখনই আশা জাগে আমরা আমাদের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে যশোরের সাগরদাঁড়ি থেকে সারা বিশ্বময় সঞ্চারিত করতে পেরেছি। বাপ্পাদিত্যের কবিতা পড়তে গিয়েও মনে হল, বাংলা সাহিত্যের যে ওজস্বিতা, যে স্বকীয়তা, যে ব্যাপকতা এবং যে গ্রহণযোগ্যতা তা এখনো ক্ষুন্ন হয়নি। বাপ্পাদিত্য তরুণ কবি, ছান্দিক আবেগের কল্লোলে যে কম্পন তিনি তুলেছেন তা হৃদয়ের গভীরে অনুক্ত মানববৃত্তীয় বৈভবেরই সদর্থক ক্রিয়াসঞ্জাত চিত্রলিপি। একদিকে আমাদের আবেগের পুনঃস্থাপন, অন্যদিকে রোমান্টিক কল্পলোকের ঘনীভূত পর্যটন যা কখনোই ক্লান্ত করে না। এক প্রাচুর্যময় দীপ্তি এবং অনন্ত প্রবাহের সমীক্ষণে আকৃষ্ট করে। সহজ একান্ত উচ্চারণে কবিতাগুলির প্রতিটি শব্দবন্ধ আমাদের ঘরকে বৈশ্বিকচেতনার অঙ্গনে পৌঁছে দেয়। আমাদের মনকে বিশ্ববীক্ষার যাপনে উন্মুক্ত করে। আমাদের শরীরকে মহাসামুদ্রিক ব্যাপ্তি দান করে। আমাদের প্রেমকে শাশ্বত স্বর্গীয় প্রেমের কল্যাণে মুগ্ধ করে। আমাদের আত্মপৃথিবীর সংকীর্ণ পথটিকে শাশ্বকালীন মহাযাত্রার মহাবোধির পথে পরিণত করে। তখনই বুঝতে পারি বাপ্পাদিত্যের কবিতা রচনা সার্থকতার উন্মুখ সিদ্ধিতে পৌঁছাতে সক্ষম। বাপ্পাদিত্য সেকথা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেন:
“তোমার মনের পাশে মনকে রেখে
খুঁজে পেয়েছি আকাশ আর স্বপ্নের মতো শরতের মেঘ
তোমার বুকে মাথা রেখে
আমি হারিয়েছি মন-ক্লান্তি অজানা ঠিকানায়
তোমার সারা শরীর জুড়ে সামুদ্রিক ঘ্রাণ
প্রদীপের শিখা লক্ষ করে আমি পথ খুঁজে চলেছি
তোমারই চোখের তারায় তারায়”
মানবীর মন যে মানব সভ্যতার সমগ্র প্রেমিকার মন, কেননা সেখানে স্বপ্ন ও আকাশের নিরলস সম্মোহন আমাদের জীবনের প্রত্যয় জাগিয়ে তুলেছে। মানবীর বুকে মাথা রেখে অজানা আবিষ্কারের প্রেরণার প্রজ্ঞা এনে দিয়েছে। শরীরের সামুদ্রিক ঘ্রাণ আদি স্রষ্টার চিরন্তন জীবন প্রবাহের ধারাকেই চিহ্নিত করে। প্রদীপের শিখা দীপ্তিময় সৌন্দর্যের হাতছানিতে অক্লান্ত করে। তখনই খুঁজে পাই বাপ্পাদিত্যের বৈশ্বিক অনুজ্ঞাকে। তখনই মনে হয় তিনি চিরন্তন মানবসভ্যতারই অকৃত্রিম ও আদি আবেগকে কবিতার শব্দে মহীয়ান করে তুলেছেন।
আরেকটি কবিতায় প্রেমের নিবিড় কল্লোলিনীকে হৃদয়ে ধারণ করেছেন যা চিরন্তন সেই আবেগেরই পুণ্যতোয়া তরঙ্গ। এই তরঙ্গ কখনো কল্লোলিনী, কখনো ঊর্মি। উত্তাল উদ্দামতায় প্রাণধর্মের জাগরণ প্রকট হয়ে উঠেছে। কবিতায় তাই বলেছেন:
“কল্লোলিনী
আজ তুমি হও মোর প্রিয়া
ঊর্মি
চোখে চোখ রেখে, হাতে হাত
এস দু’জন দু’জনাতে
বিলীন হয়ে যাই
উত্তাল হোয়ো না
উদ্দামতা আমার ভালো লাগে না”
এই আবেগ আদি-অন্তহীন স্রষ্টার সৃষ্টির আবেগ। এর কোনো ব্যত্যয় নেই। এর কোনো অস্বীকার নেই। এই আবেগ কাউকে বোঝানো যায় না। টি এস এলিয়ট এই কারণেই বলেছেন:”It is obvious that we can no more explain a passion to a person who has never experienced it than we can explain light to the blind.” যারা অভিজ্ঞ তারা জানেন এই আবেগের মর্মার্থ। অন্ধকে যেমন আলোর ধারণা দেওয়া যায় না, তেমনি এই আবেগকেও বোঝানো সম্ভব নয়। তা হৃদয়ের উৎসে উৎসারিত আমাদের চিরন্তন প্রবৃত্তির স্বয়ংক্রিয় উল্লাস। বাপ্পাদিত্য এরই নামকরণ করেছেন ‘হৃদয়তান্ত্রিক’। প্রতিটি কবিতাতেই এই হৃদয়তন্ত্রের অসাধারণ উদযাপন প্রতিটি সহৃদয় ব্যক্তিকেই স্পন্দিত করবে।

তিনজন কবির সঙ্গে কথা বলতে পারেন :
১,আব্দুল বাসার খান:+919775333058
২,অনিমেষ মণ্ডল :+917908279012
৩,বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়:+917908404788
প্রথমজন বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়,



আব্দুল বাসার খান