পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার মন্তেশ্বর জনপদের আরাধ্য দেবী চামুণ্ডা, সেই প্রাক-ব্রিটিশ পর্ব থেকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজের আঙিনায় এই দেবী পূজিত হয়ে আসছেন! এখনো মন্তেশ্বরবাসী দেবী আরাধনায় সেই প্রাচীনত্বের সুর ধরে রেখেছেন! দেবীর এই আরাধনা শুরু হয় অক্ষয় তৃতীয়ায় ‘ময়ূর নাচ’ অনুষ্ঠানকে কে কেন্দ্র করে এবং শেষ হয় দশমীর দিন বিকালে ময়ূর নাচ সহ বিভিন্ন ধারাবাহিক অনুষ্ঠান বাইচ এর পর দেবীর গৃহপ্রবেশ অর্থাৎ মূল মন্দিরের ফিরে আসার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে! উল্লেখ্য যে বর্ধমান মহারাজ কীর্তি চাঁদ ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে এই দেবীর মন্দির নির্মাণ করেন, এবং সুষ্ট ভাবে পূজা পরিচালনার জন্য পুরোহিত সহ সমস্ত সেবাইতদের জমি প্রদান করে পূজার যাবতীয় ভার বহন করেন! আজও বর্ধমান মহারাজদের নামে পূজা উৎসর্গ এবং বলি প্রদত্ত হয়!
দেবী চামুণ্ডা একসময় অরণ্য অনার্য জাতি আরাধ্য দেবী ছিল। প্রাচীন ভারতীয় গবেষক এবং সমাজ সংস্কারক R.K Bhandarkar এর মতে দেবী চামুণ্ডা অনার্য দেবী, তিনি একসময় মধ্য ভারতের বিন্ধ অঞ্চলের অরণ্য জাতির মধ্যে পূজিত হতেন । পরবর্তীকালে প্রায় সারা ভারতেই এই দেবীর আরাধনা শুরু হয়! দেবী চামুণ্ডা ভয়াল রুদ্ররূপী, মহামায়ার ভ্রুকুটি কুটিল ললাট থেকে তার সৃষ্টি!
মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে দুই অসুর শুম্ভ-নিশুম্ভের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্বর্গের দেবতারা দেবী
মহামায়ার শরনাপন্ন হন,এদিকে দেবী শম্ভু নিশুম্ভ কে বধ করতে উদ্যত হলে, তারা চন্ড মূন্ড নামে দুই ভয়ঙ্কর অসুর কে দেবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রেরণ করে, তখন চন্ড- মুন্ড অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হয়ে পদাতিক বাহিনী নিয়ে দেবীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে দেবী মহামায়া এতই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন যে তাঁর রক্তিম মুখমন্ডল কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করে, তখনই দেবীর ভ্রুকুটি কুটিল ললাট থেকে এক ভীষন বদনা, লোল জিহ্বা, ভয়াল কোটরাগত আরক্ত চক্ষু বিশিষ্ট, উগ্ৰরুপী এক ভয়ঙ্কর দেবীর আবির্ভাব ঘটে, এই দেবীই চন্ড মূন্ড সহ রক্তবীজ ও অন্যান্য অসুরদের বধ করে, তাদের রক্ত পান করে রণরঙ্গিনী বেশে দেবী মহামায়ার সম্মুখে হাজির হয়, এই ভয়াল দেবীই চামুণ্ডা রূপে পরিচিত হয়!
উল্লেখ্য যে দেবী চামুণ্ডা সপ্তমাতৃকার অন্যতম এবং অনন্য, একক পূজিতা স্বয়ং দিব্য জননীর শক্তির
এক ভয়াল রুপ,তিনি ত্রিনয়না, শব উপবিষ্টা, কোটরাগতা, রক্তিম চক্ষু,অস্থি চর্ম কঙ্কালসার, ডমরু, ত্রিশুল, খরগো, খট্বাঙ্গ ,মুন্ডুমালাদি শোভিতা এক ভয়াল দেবী!
মন্তেশ্বরের দেবী চামুণ্ডা কষ্টি পাথরের তৈরি এক অনন্য শিল্প ভাস্কর্যের নিদর্শন! এখানে দেবী কৃষ্ণবর্ণা, দশোভূজা, শুষ্ক কঙ্কালসার, শবশায়িতা, লম্বিতস্তনা, সম্মুখ প্রসারিত দন্ত পংক্তি, ব্যাঘ্র চর্ম পরিহিতা, অলংকার মুণ্ডমালা ভূষিতা, তাছাড়া দেবী সলজ্জ ভঙ্গিতে মহাকালের ওপর নিত্যরতা! মূর্তিটিতে দেখা যাচ্ছে দেবী বামপাশের এক হাতে ত্রিশূল দিয়ে চন্ড মূন্ড কে বধ করছেন, অন্য একহাতে শূল, একহাতে মুন্ডু, একটি হাত অনামিকা ওষ্টে আলতো ছোঁয়া, দেবীর অপর বাম হাত পশ্চাদভাগে উত্তোলিতা, দেবীর ডানপাশে হাতে রয়েছে যথাক্রমে পানপাত্র,আসি, ডমরু এবং খট্বাঙ্গ আর এক হাত পশ্চাদ্ভাগে উত্তোলিতা! তাছাড়া সুসজ্জিত চালচিত্রে অবস্থান করছেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-সহ অন্যান্য দেবতাগণ, দেবীর দুপাশে রয়েছে ডাকিনী যোগিনী, তারাও অস্ত্র সজ্জায় সজ্জিতা, শ্মশানে ভ্রমণ রত শৃগাল, আবার অনামিকায় আলতো কামড় মেরে লজ্জা ভূষনরতা, অভয় দাত্রী দেবীর এক অনন্য শিল্প ভাস্কর্যের নিদর্শন, এই মূর্তিটিতে বিরাজমান!
শিল্পীর এই শিল্পভাবনার নিরিখে বলা যায়, শিল্পী হয়তো মার্কেন্ডেয়, চন্ডী এবং কালিকা পুরানের প্রভাবিত হলেও তার সাথে নিজ সমকালীন চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটিয়েছেন তার নিপুন ছেনিতে, মূর্তিটির শিল্প-সৌন্দর্য দেখলে সেটাই অনুমান হওয়া স্বাভাবিক! শিল্পী হয়তো সমকালীন চিন্তা-চেতনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন! বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক সাংবাদিক বিনয় কুমার ঘোষ পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে ক্ষেত্রসমীক্ষায় যখন গোটা বাংলা চষে বেরিয়েছিলেন, তার ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ গ্রন্থ রূপায়নে, তখন তিনি এই চামুণ্ডা মূর্তি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন, তিনি চোল, পল্লব চালুক্য ভাস্কর্য থেকে উড়িষ্যা বা বাংলা শিল্পরীতির বিবর্তনের দিকটায় খুঁজে পেয়েছিলেন! সাধারণত ভারতীয় দেবীদের যে সুডৌল বক্ষ সমন্বিত তারুণ্য সৌন্দর্যের রুপ সাধারণত দেখা যায়, এখানে কিন্তু তা অনুপস্থিত, এখানে দেবী অস্থি চর্মসার ক্ষয়িষ্ণু ভয়াল কোটরাগত আরক্ত চক্ষু, এইরূপ জরা মৃত্যু ধ্বংসের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত! আর অন্যদিকে সৃষ্টির রূপটিকেও উপেক্ষা করা যায় না!
মূর্তিটি নিপুণভাবে পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে শিল্পীর মূর্তি নির্মাণের দ্বৈত ভাবনা কাজ করেছে, শিল্পী ধ্বংসের ভয়াল রূপ যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন দেবীর দৈহিক গঠন, অস্ত্রসজ্জা এবং যুদ্ধ উন্মাদনার ভয়াল পরিবেশ তৈরি করে, তেমনি বাম হাতের অনামিকায় ওষ্টে আলতো কামড়, সলজ্জ চাওনি, উত্তোলিত দুহাত, অভয়দাত্রী সৃষ্টির এইরূপ টাও কিন্তু ভুলে যাননি! এই শিল্পের মাধ্যমে শিল্পীর সমকালীন সময়ের সমাজ ভাবনার দিকটাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে!
শিল্পকর্মটি কোন যুগের তা নিয়ে দ্বিমত থাকাটাই স্বাভাবিক! তবে মূর্তিটিকে চালচিত্র নির্মাণ রীতি দেখে পাল যুগের শেষ পর্যায়ে মনে হওয়াই স্বাভাবিক! দশম শতকের শেষ পর্যায়ে, মহীপালের আমলের সময় থেকেই বাংলার শিল্পচর্চার কেন্দ্রগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে, এইসময় পর্বে থেকেই বৌদ্ধধর্ম ক্ষয়িষ্ণু হয়ে ওঠে, তান্ত্রিক হিন্দুধর্ম বিকশিত হতে থাকে! শিল্পচর্চার পুনর্জাগরণ লক্ষ্য করা যায়! এর প্রভাব শিল্প সংস্কৃতির উপর পড়েছিল! একাদশ শতকের মাঝে মাঝে সময়ে নয় পালের আমলে বাংলায় চামুন্ডা পূজার সূত্রপাত ঘটি! তার বানগড় লিপিতে দেবী চামন্ডার স্তুতি বা স্তবের উল্লেখ আছে! আর উল্লেখ্য যে একাদশ শতকে ভাস্কর্যের পশ্চাৎপট বিভিন্ন দৃশ্যাবলী শোভা পায়, আরো লক্ষণীয় যে মূর্তির কে ঘিরে ছোট ছোট মূর্তি তৈরি প্রয়াস এই সময় থেকেই শুরু হয়! এই ধারা প্রাক সেন পর্ব পর্যন্ত অব্যাহত থাকে! সেই হিসেবে এই শিল্প-সৌন্দর্য টি পাল যুগের শেষ বা সেন যুগের প্রথম পর্বের বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক!
## মন্তেশ্বরের দেবী চামুন্ডা: বারিদ বরন গুপ্ত পূর্ব বর্ধমান)
Barid Baran Gupta