নববর্ষ বাঙালির আপন সংস্কৃতির মধ্যেই ছিল:: একটি সমাজতাত্ত্বিক পর্যালোচনা
বারিদ বরন গুপ্ত
নববর্ষের সঙ্গে বাঙালির একটা নাড়ির টান, প্রাচীন গ্রামবাংলার কৃষিজীবী পরিবারগুলির ফসল উৎপাদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেনা -পাওনা মেটানোর বা বিনিময় এবং নতুন সম্পর্কের সাপেক্ষে একটা আনন্দ অনুষ্ঠান হল নববর্ষ! তাই আমরা বলতে পারি যে সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই নববর্ষ বঙ্গ সংস্কৃতির মধ্যেই ছিল! কৃষিজীবী পরিবারগুলি সেই প্রাচীনকাল থেকেই নববর্ষ অনুষ্ঠান পালন করে আসছে! সারা বছর ধরে বাঙালি কৃষিজীবী পরিবারগুলি তাদের কৃষি ফসলের উৎপাদন কে কেন্দ্র করে সারাবছর নানান ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, ভালো ফসলের আশায় প্রকৃতি পুজো, অতিন্দ্রীয় শক্তির আরাধনা, টোটেম প্রথার অঙ্গ হিসেবে প্রাচীন গ্রাম সমাজ অতিন্দ্রীয় শক্তি, সূর্য- পৃথিবীর আরাধনা, দেবাদিদেব এর আরাধনা! এসবই কৃষিজীবী গ্রাম সমাজ করেছিল ভালো ফসল উৎপাদনের জন্য, পরবর্তীকালে এগুলো আপন সংস্কৃতিতেই বিরাজিত হয়েছে,একথা মনে করা যেতেই পারে।
পরবর্তী পর্বে সময়ের সাপেক্ষে সমাজের বিবর্তন ঘটেছে, দেবতাত্ত্বিক সমাজ থেকে অধিবিদ্যক সমাজ হয়ে, সমাজ রাজতন্ত্রের যুগে প্রবেশ করেছে! ফসলের একটা অংশ হিসেবে করব্যবস্থায় রাজা-প্রজার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে! তাছাড়া স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজকে যজমান এবং কামিন দের অর্থাৎ দাতা গ্রহীতার সম্পর্ক বিনিময় প্রথার মাধ্যমেই নিষ্পত্তি হতো , হয়তো সেটা বাৎসরিক নিষ্পত্তি হতো একটা নির্দিষ্ট দিনেই, নতুন দিনের নতুন আশায় সৃষ্টি হয়েছে নববর্ষ অনুষ্ঠান! রাজতন্ত্রের যুগে,রাজা প্রজাদের সম্পর্কের ভিত্তি ছিল কর হিসেবে শষ্যের আদান-প্রদান! হয়তো তৎকালীন গ্রাম সমাজের একটা নির্দিষ্ট দিনেই তা মেটানো হত এবং সেই উপলক্ষে একটা আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন
অবশ্যই করা হতো,যেমন একসাথে খাওয়া দাওয়া আমোদ-প্রমোদেরও ব্যবস্থা ছিল বলে মনে করা যেতে পারে! সেই সূত্র ধরেই শুরু হয়েছে পুরনো বকেয়া শোধ করে নতুন সম্পর্কের সূত্রপাত যা নববর্ষের রূপ নিয়েছে! সে হিসেবে বলতে পারি নববর্ষ বাঙালির আপন সংস্কৃতির মধ্যেই ছিল!
নববর্ষ কে চালু করেছিলেন সম্রাট আকবর না গৌড়ধিপতি শশাঙ্ক , এই নিয়ে মতভেদের অন্ত নেই! সবাই নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন! কিন্তু একটা কথা কিন্তু পরিস্কার! শশাঙ্কের আগেও রাজতন্ত্র ছিল! তখনো শস্য বা করের বিনিময় হত! শশাঙ্ক থেকে আকবর দীর্ঘ ইতিহাস! এই সময় কি রাজাদের সন তারিখের একটা নির্দিষ্ট দিনের কর ব্যবস্থা ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল! তৎকালীন যুগের রাজাদের সঙ্গে প্রজাদের সম্পর্ক তো ওই কর হিসেবে ফসলের দাবি দাওয়া! এবং খুব সম্ভবত তা মেটানো হতো স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজের গ্রাম প্রধানের মাধ্যমে ! পুরনো দেনা-পাওনার অবসান এবং নতুন করে হিসাব-নিকাশের শুরু! সেই উপলক্ষে অনুষ্ঠান! যাকে আমরা বর্তমানে নববর্ষের বিবর্তিত রূপ বা অনুষ্ঠান বলে থাকি! তাই গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক ষষ্ঠ শতকে যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজের কাছে এই দিন কর প্রদানের নতুন সূচনা পর্বের অনুষ্ঠানের স্বীকৃতি হিসেবে নববর্ষ চালু করে থাকেন, সেই একই তিথি অনুযায়ী পরবর্তী কালের রাজা বা সম্রাটরা হাটবেন এটাই স্বাভাবিক! কারণ কৃষিজীবী পরিবারগুলির ফসল উৎপাদন এবং তা থেকে কর প্রদান ঋতু বা তিথির হেরফের হবে না! অতএব আমি সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে পারি যে নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যেই ছিল এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই!
*** শুভ নববর্ষ! সকলকে শুভেচ্ছা জানাই!
Barid Baran Gupta