প্রতিটি কবিতাই আত্মদর্শী প্রজ্ঞার অনুচ্চ স্বর
🎄
তৈমুর খান
🇧🇧
সরল ও এক সহজ আত্মযাপনের নিবিড় প্রবাহ থেকে কবিতার ধারায় স্নাত হতে জানেন কবি শংকর ব্রহ্ম (১৯৫১)। সাতের দশক থেকে নিরলস ভাবে কাব্য চর্চা করলেও নির্বিবাদী নিরীহ মানুষটি যশ ও খ্যাতির জন্য কখনো হইচই করেননি। নিজেকে নির্বাসিত রেখেই নীরবে একান্ত নিষ্ঠায় সাহিত্য চর্চা করে গেছেন। চলার পথে বহু বিশিষ্ট কবির সঙ্গেই তাঁর সাক্ষাৎ ঘটেছে এবং সান্নিধ্যও লাভ করেছেন। তাঁর কবিতার মধ্যে সর্বদা এক আত্মদর্শী প্রজ্ঞার অনুচ্চ স্বর শোনা যায়। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘কবি হতে চাইনি’ (পহেলা বৈশাখ ১৪৩০) কাব্যটির মোট ৪০ টি কবিতায় তিনি সরাসরি ব্যক্তি জীবনের আসক্তি ও আবেগকে অন্তর্বাহ শব্দচারুণায় রূপ দিয়েছেন। সাতের দশকে যে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছিল মূলত তারই ছায়া পড়েছে কবিতাগুলিতেও। তবে আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যে তিনি অভিনবত্ব আনার চেষ্টা করেছেন।
কাব্যটিতে কবি হতে না চাওয়া কবিই যে শেষপর্যন্ত কবি হয়ে উঠেছেন তা পাঠ করলেই বোঝা যাবে। ব্যক্তি জীবনে শংকর ব্রহ্ম একজন অনুভূতি প্রবণ দরদি মানুষ। তাই নানা অসামঞ্জস্য অন্তরায় কাটিয়ে প্রেমের আবেগকেই তিনি তাঁর উজ্জীবনের মূলধন করে তুলেছেন। দীর্ঘ জীবনপথের অভিজ্ঞতা থেকে স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলি উল্টিয়ে গেছেন। সেসব পৃষ্ঠাতেই সংরাগের স্বপ্ন কবিকে রোমাঞ্চিত করেছে, তখন তা লিখতে বাধ্য হয়েছেন। নিজেই জানিয়েছেন:
“একটি সাদাপাতা কবির মুখোমুখি প্রতীক্ষায়
কলঙ্কিত হবার প্রত্যাশায়,
কবি অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন কার দিকে
প্রথম শব্দটা কী লিখবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।
কবি তার শুদ্ধতার মোহে পড়ে গেছেন যেন মনে হয়,
কাটাকুটি করা তার ইচ্ছে নয়,
ভাবলেন ‘ভালোবাসা’ কথাটি লিখবেন,
তারপর ভাবনায় পড়লেন তিনি।”
ভালোবাসা শব্দটিই তুমুল সংরাগের জন্ম দিয়েছে। এই জীবন, এই সৃষ্টি, এই স্বপ্নের যাবতীয় জগৎ তারই রচনা। কবিও ভালোবাসাতেই নিজেকে নিষিক্ত করলেন। রাত্রির অন্ধকারে নিজের নবজন্ম খুঁজলেন । তারপর শান্তির সকালের আবির্ভাব হলে দেখলেন:
“বহুকাল অপেক্ষার পর এমন সকাল আসে জীবনে একবার”
এই সকালেই প্রিয় পৃথিবী, প্রিয় জন্ম আবার নবজন্মের জন্য প্রস্তুত হয়। তখন পাখির নীড়ে ডিম দেখে স্বপ্ন আসে মনে:
‘আমার তো ডিমের ভিতরে যেতে খুব ইচ্ছে করে”
একদিকে প্রকৃতির মধ্যে নিজের অবস্থান, অপরদিকে আত্মরতির গভীর অনুজ্ঞা কবিকে পরামর্শ দিতে থাকে। স্বপ্নের মৃত নদীও জোয়ারে ভর্তি হয়। প্রেম প্রত্যাশী জীবনের স্মৃতিস্রোতে নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। ভাবের রাজ্যে কবি কখনো শূন্যতাকেও প্রশ্রয় দেন না। তাই না থাকাও কবির কাছে নাথিং নয়। শুধু আড়াল মাত্র। মনের মধ্যে না-পাওয়া মেয়েটির মুখ জেগে ওঠে। না-পড়া বইটিও উঁকি মারে। ভুল শব্দের ভিড়ে আসল শব্দটিও এক সময় পেয়ে যান। ডুগডুগির মতো সেই শব্দও বেজে উঠতে পারে। কখনো মশাল হয়ে আলোকিত করে। কখনো আগুন হয়ে সংস্কারগুলি পুড়িয়ে দেয়। কবি চান মানবতাতেই মর্ত্যলোক ভরে উঠুক।
তবুও কবির মনে সংশয় দূর হয় না। কবিতায় আত্মপ্রশ্ন এবং আর্তপ্রশ্ন ফিরে আসে:
“কার চোখে খুঁজে ফেরো
জীবনের নবধারাপাত?
কার কাছে জমা রেখে চলে যাবে
কবিতার এই দায়ভার?
মনে যাকে ভয়, হিংস্র এই পৃথিবীতে
কবিতাকে রাখবে কোথায়?”
হৃদয়ের ধনকে যত্ন রাখতে হবে। মানবের সম্পদকে তো মেধাবী আলোয় সংরক্ষিত করতে হবে। কিন্তু রণ-রক্ত-রিরংসা ভরা পৃথিবীতে সেই কবিতা কিভাবে বাঁচবে? যদি মানবের মুখ ভালোবাসার দিকে ফিরে তাকায় তবেই পৃথিবীও ফুলের বাগান হয়ে যাবে। কবি তাই লিখলেন:
“মুখটা ফেরালে রাতের সমস্ত পাপ ধুয়ে মুছে সাফ
ফুটে আছে দেখি একঝাঁক উজ্জ্বল গোলাপ।”
বিশ্বনাগরিক কবি সর্বদা সমগ্রের কথা ভেবেছেন। আগামির পৃথিবী মানুষ বাসের উপযোগী হোক—এটাই কামনা করেছেন। অন্যদিকে নিজের জীবন, নিজের ফুরিয়ে যাওয়া, ছন্দে গতিময় হয়ে ওঠা, নিজের মতন করে বেঁচে থাকাও কবির ভাবনায় দেখা দিয়েছে। তারপর কবিতার কাছে বসা। সেখানেই ‘জীবন আর মৃত্যুর সঙ্গম’ রেখে যাবেন। সুখ, ভালোবাসাকে চিরন্তন করে তুলবেন। গোপন কান্নাকে গোপন করেও চোখের জলে কলম ডুবিয়ে ইতিহাস লিখতে দেখেছেন নিগ্রো কবি ল্যাংস্টন হিউজকে। সময়ের দুর্বার ঘূর্ণনে এক অসহায় কবি ডুবে গেছেন। ভালোবাসার কাছে ফিরে এসে উপলব্ধি করেছেন শব্দটি আজও ক্লিশে হয়ে যায়নি। আজও সূর্যের মতো উজ্জ্বল। এই কারণেই আমেরিকান লেখক জেমস আর্থার বাল্ডউইন (১৯২৪-১৯৮৭) বলেছিলেন:
“Love does not begin and end the way we seem to think it does. Love is a battle, love is a war; love is a growing up.”
অর্থাৎ ভালোবাসা শুরু এবং শেষ হয় না যেভাবে আমরা মনে করি এটি করে। প্রেম একটি লড়াই, প্রেম একটি যুদ্ধ; ভালোবাসা হচ্ছে বেড়ে ওঠা। এই ভালোবাসার কাছেই জীবনের জয়গান শুনেছেন। কবিতায় বলেছেন:
“প্রশংসার পিছে লাথি মেরে
এগোতে সামনের দিকে
জীবনের গান কন্ঠে ধরে।”
জীবনের এই গান স্বপ্নের ওড়ানের মতো কবির কাছে ফিরে এসেছে। তাই একদিন জীবনানন্দীয় চেতনায় এই মাঠ-ঘাট-ঘাসের শিশির বিন্দুতে মিশে যাবেন। আকাশ নক্ষত্র জ্যোৎস্না হয়ে কবিসত্তা বিরাজ করবে। বর্ষার মেঘেরাও কবিকে ডেকে নেবে। অভিমান জেগে উঠলেও নীরবতা কবিকে ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে রাখবে। দেওয়াল জুড়ে কবি লিখে যাবেন ‘আমি ভালো নেই’। নীরব কান্নার ভাষা হয়ে হয়তো তা বিরাজ করবে। তবু এটাই কবির শেষকথা—ভালোবাসা থেকে আর পৃথিবীতে অন্যকিছু মূল্যবান নেই।
🚩
কবি হতে চাইনি: শংকর ব্রহ্ম, প্রকাশ ও প্রকাশনী: শংকর ব্রহ্মের লেখালেখি, প্রচ্ছদ অলংকরণ: কবিতা মিত্র, আশুতোষ পল্লী, গড়িয়া, কলকাতা ৭০০০৮৪

শংকর ব্রহ্ম