২০২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত নেপচুন গ্রহ চিত্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে NASA এর James Webb Space Telescope সৌরজগতের আরেকটি বরফ দৈত্য ইউরেনাস (Uranus) গ্রহের অত্যাশ্চর্য চিত্র ধারণ করেছে । নতুন চিত্রটিতে ইউরেনাসের নাটকীয় বলয়গুলোর পাশাপাশি এর বায়ুমণ্ডলের উজ্জ্বল আবছায়া বৈশিষ্ট্য রয়েছে । এর আগে NASA এর Hubble Space Telescope এবং হাওয়াই এর মাউনাকেয়ার উন্নত অভিযোজিত দৃষ্টিশক্তিসংক্রান্ত ডব্লিও.এম কেক পর্যবেক্ষণিকা ( W.M. Keck Observatory) দ্বারা গ্রহটিকে পর্যবেক্ষণ ছাড়াও ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে ভয়েজার ০২ (Voyager ০2) মহাকাশযান গ্রহটির পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছিল ৷ যদিও তারা গ্রহের বায়ুমণ্ডলীয় বলয়গুলোর অস্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেছে । কিন্তু Webb গ্রহটির উজ্জ্বল বায়ুমণ্ডলীয় বৈশিষ্ট্য এবং সবচেয়ে কম ধূলিকণাময় বলয়গুলোর জন্য পর্যবেক্ষণিকার অভূতপূর্ব সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে । ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের ০৬ই ফেব্রুয়ারী Webb এর Near-Infrared Camera (NIRCam) থেকে ধারণ করা ইউরেনাসের এই জুম-ইন চিত্রটি গ্রহের বলয়ের অত্যাশ্চর্য দৃশ্য প্রকাশ করে । এই অবলোহিত চিত্রটি ১.৪ এবং ৩.০ মাইক্রনের দুটি পরিস্রুত বা ছাঁকনি (F140M, F300M) থেকে তথ্য একত্রিত করে, যা এখানে যথাক্রমে নীল এবং কমলা রঙে দেখানো হয়েছে । ফলস্বরূপ প্রতিনিধি-রঙিন চিত্রে গ্রহটি একটি নীল আভা প্রদর্শন করে । সূর্য থেকে সপ্তম গ্রহ ইউরেনাস ৷ এই গ্রহটি তার কক্ষপথের সমতল থেকে প্রায় ৯০ ডিগ্রী কোণে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে । ইউরেনাস সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে ৮৪ বছর সময় নেয় ৷ এটি এক চরম ঋতু সৃষ্টি করে কারণ গ্রহের মেরুগুলো ৪২ বছর ধরে স্থির বা অবিরাম সূর্যালোক অনুভব করে এবং তারপরে ৪২ বছর ধরে সম্পূর্ণ অন্ধকার থাকে ৷ পৃথিবীর ১৭ ঘন্টা ১৪ মিনিটের সমান ইউরেনাসের ০১টি দিন ৷ বর্তমানে ইউরেনাসের উত্তর মেরুতে বসন্তের শেষের দিকে, যা এখানে দৃশ্যমান । গ্রহটির উত্তরে গ্রীষ্মকাল হবে আগামী ২০২৮ খ্রিস্টাব্দে । বিপরীতে, ভয়েজার ০২ মহাকাশযান যখন ইউরেনাসকে পরিদর্শন করেছিল তখন দক্ষিণ মেরুতে গ্রীষ্মকাল ছিল । দক্ষিণ মেরু এখন গ্রহের ” অন্ধকার দিকে ”, দৃশ্যের বাইরে এবং মহাকাশের অন্ধকারের মুখোমুখি । ভয়েজার ০২ মহাকাশযান যখন ইউরেনাসের দিকে তাকায়, তখন এর ক্যামেরায় দৃশ্যমান তরঙ্গদৈর্ঘ্যে গ্রহটি প্রায় বৈশিষ্ট্যহীন নীল-সবুজ বল দেখায় । কিন্তু Webb এর অবলোহিত তরঙ্গদৈর্ঘ্য এবং অতিরিক্ত সংবেদনশীলতার সাথে আমরা এটিকে আরো বিশদ দেখতে পাই যে, ইউরেনাসের বায়ুমণ্ডল সত্যিই কতোটা গতিশীল । গ্রহের ডানদিকে সূর্যের মুখোমুখি মেরুতে উজ্জ্বল হওয়ার একটি এলাকা রয়েছে, যা মেরু টুপি (Polar cap) নামে পরিচিত । এই মেরু টুপিটি ইউরেনাসের জন্য অনন্য – গ্রীষ্মে যখন মেরুটি সরাসরি সূর্যালোকে প্রবেশ করে এবং শরৎকালে অদৃশ্য হয়ে যায় তখন এটি প্রদর্শিত হয় ৷ মেরু টুপিটি আগামী ২০২৮ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর মুখোমুখি হবে । তাই ওয়েব (Webb) এবং হাবল (Hubble) দূরবীক্ষণ যন্ত্রকে এটির কাঠামো সম্পর্কে আরো বিশদে চিত্রিত করার সুযোগ দেবে । এছাড়া Webb এর তথ্য বিজ্ঞানীদের বর্তমান রহস্যময় প্রক্রিয়া বা বিশেষ কৌশল বা পদ্ধতি বুঝতে সাহায্য করবে । সত্যিকার অর্থে দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি ইউরেনাস গ্রহের মেরু টুপির একটি আশ্চর্যজনক দিক প্রকাশ করেছে, যেখানে মেরু টুপির কেন্দ্রে একটি সূক্ষ্ম বর্ধিত উজ্জ্বলতা । Webb দূরবীক্ষণ যন্ত্রের NIRCam এর সংবেদনশীলতা এবং দীর্ঘতর তরঙ্গদৈর্ঘ্যে এই বর্ধিত ইউরেনাসের মেরু বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাচ্ছি, যখন হাবল স্পেস টেলিস্কোপ (Hubble Space Telescope) কিংবা কেক পর্যবেক্ষণিকার (Keck Observatory) মতো অন্যান্য শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে এটিকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়নি । মেরু টুপির প্রান্তে একটি উজ্জ্বল মেঘের পাশাপাশি টুপির প্রান্তের ঠিক বাইরে অল্পসংখ্যক ক্ষীণ বর্ধিত বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং আরেকটি খুব উজ্জ্বল মেঘ গ্রহের বাম অঙ্গে বা প্রধান শাখায় দেখা যায় । এই ধরনের মেঘগুলো ইউরেনাসের আদর্শস্বরূপ বা প্রতিরূপ এবং সম্ভবত ঝড়ের কার্যকলাপের সাথে যুক্ত । তাই এর আকাশে ঝড়ের মেঘের আধিপত্য রয়েছে । যদিও NASA এর Hubble Space Telescope গত বছর নভেম্বরে ইউরেনাসের উজ্জ্বল সাদা মেরু টুপির চিত্র ধারণ করেছিল । এই গ্রহটিকে তার অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক গঠনের কারণে একটি ‘বরফ দৈত্য’ (Ice giant) হিসেবে চিহ্নিত করা হয় । এর বেশিরভাগ ভর গরম বলে মনে করা হয়, ” বরফযুক্ত ” (Icy) পদার্থের ঘন তরল – জল (৮০% বা তার বেশি), মিথেন এবং অ্যামোনিয়া – একটি ছোট পাথুরে কেন্দ্র বা অন্তস্তলের উপরে ৷ সূর্য থেকে ১.৮ বিলিয়ন মাইল (প্রায় ৩ বিলিয়ন কিলোমিটার) দূরে বৃষ নক্ষত্রমণ্ডলে এর অবস্থান ৷ এর আয়তন পৃথিবীর প্রায় ৬৪ গুণ বড় এবং ওজন প্রায় ১৫ গুণ ৷ গ্রহের আবহমণ্ডলে অত্যধিক পরিমাণ মিথেন, হিলিয়াম এবং হাইড্রোজেন গ্যাসীয় বলয় রয়েছে ৷ এই গ্যাসের কারণেই গ্রহটি নীল দেখায় ৷ গড় তাপমাত্রা -১৯৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং শীতলতম অবস্থায় তাপমাত্রা -২২৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস । বিষুব অঞ্চলে বাতাসের গতিবেগ প্রায় ২৫০ মিটার/সেকেন্ড ৷ সম্ভবত প্রাণের কোনো অস্তিত্ব নেই ৷ অনেক জ্যোতির্বিদ পূর্বে গ্রহটিকে লক্ষ্য করলেও স্যার উইলিয়াম হার্শেল (Sir William Herschel) প্রথম ১৩ মার্চ ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে এটি আবিষ্কার করেন ৷ জার্মান বিজ্ঞানী Johann Elert Bode এই গ্রহের নাম দেন ইউরেনাস ৷ সৌরজগতের তৃতীয় বৃহত্তম গ্রহ ইউরেনাস বিশিষ্ট ঘনকেন্দ্রিক বলয় (Ring) দ্বারা ঘিরে রয়েছে । এর ১৩টি পরিচিত ধূলিময় বলয় রয়েছে । এদের মধ্যে ১১টি বলয় Webb এর ধারণকৃত ছবিতে দৃশ্যমান । ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে এবং ২০২২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ (Hubble Space Telescope) দ্বারা ধারণকৃত চিত্রে ইউরেনাসের বলয় তন্ত্রটি আরো ক্ষীণভাবে দৃশ্যমান ছিল । সৌরজগতের কক্ষপথের সমতলের তুলনায় ইউরেনাসের একটি চরম কাত রয়েছে, যেমন এর উত্তর মেরু বর্তমানে সূর্যের দিকে অভিমুখী । গ্রহটি তার পাশে কাত হয়ে অনন্য, যার ফলে শনি গ্রহের অনুভূমিক বলয় তন্ত্রের বিপরীতে এর বলয়গুলো উল্লম্বভাবে প্রদর্শিত হয় । চরম ঋতু এবং ঝড়ো আবহাওয়ার কারণে ইউরেনাস কাত হয় । এই বলয়গুলোর মধ্যে কিছু এতোই উজ্জ্বল যে যখন তারা একত্রে কাছাকাছি থাকে এবং তখন তাদের একটি বৃহত্তর বলয়ে একত্রিত হতে দেখা যায় । ০৯টি বলয়কে গ্রহের প্রধান বলয় হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয় এবং ০২টি হচ্ছে অস্পষ্ট বা ক্ষীণ ধূলিকণার বলয় (যেমন গ্রহের সবচেয়ে কাছের ডিফিউজ জেটা বলয় বা Diffuse zeta ring), যেগুলো ভয়েজার ০২ মহাকাশযান মিশন ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের উড়ান (Flyby) পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি । যদিও এই ০২টি বলয়কে তাদের ধুলোময় গঠনপ্রণালীর (Makeup) কারণে ক্যামেরাবন্দি বা ধারণ করা কঠিন । তবে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে Webb ভবিষ্যতে ইউরেনাসের অস্পষ্ট বাইরের বলয় ০২টির ছবি ধারণ করে প্রকাশ করবে, যেগুলো ২০০৭ রিং-প্লেন ক্রসিংয়ের (2007 ring-plane crossing) সময় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ (Hubble Space Telescope) দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছিল ৷ NASA এর গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের (Goddard Space Flight Center) গবেষণা বিজ্ঞানী Dr. Naomi Rowe-Gurney বলেন, ”একটি গ্রহের বলয় তন্ত্র বা প্রণালী তার উৎপত্তি এবং গঠন সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু বলে । ইউরেনাস একটি অদ্ভুত জগত, যার পাশের দিকে কাত এবং অভ্যন্তরীণ তাপের অভাব যা আমরা এর ইতিহাস সম্পর্কে যে কোনো সূত্র পেতে পারি তা অত্যন্ত মূল্যবান । তিনি আশা করেন Webb দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি ইউরেনাসের বায়ুমণ্ডলীয় রচনা সম্পর্কে আরো উন্মোচন করবে এবং বিজ্ঞানীদেরকে এই অস্বাভাবিক গ্যাস দৈত্যটি সম্পর্কে আরো ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে । এছাড়া অবলোহিত তরঙ্গদৈর্ঘ্যে নতুন গভীরতা এবং বৈশিষ্ট্যগুলো দেখাতে পারে যা ভূমি থেকে বায়ুমণ্ডলে দেখা কঠিন ।” Webb ইউরেনাসের ২৭টি পরিচিত চাঁদ বা উপগ্রহের অনেকগুলো ধারণ করেছে, যেগুলোর বেশিরভাগই এখানে দেখা যায় না কারণ খুব ছোট এবং অস্পষ্ট ৷ সবচেয়ে উজ্জ্বল ০৬টি চাঁদকে বিস্তৃত বা প্রশস্ত-দর্শন ছবিতে (Wide-view image) চিহ্নিত করা হয়েছে যেমন: পাক (Puck), এরিয়েল (Ariel), মিরান্ডা (Miranda), আমব্রিয়েল (Umbriel), বহির্মুখী টাইটানিয়া (Titania) এবং ওবেরন (Oberon) । অভ্যন্তরীণ চাঁদগুলো প্রায় অর্ধেক জল বরফ এবং অর্ধেক পাথর বলে মনে করা হয় । তবে, বাইরের চাঁদের গঠন সম্পর্কে কম জানা যায় । নীলাভ এই রহস্যময় গ্রহটি পর্যবেক্ষণ করার সময় Webb কি করতে পারে, এটি শুধু Tip of the iceberg । ২০২২ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিসিন (National Academies of Sciences, Engineering and Medicine) তার ২০২৩ – ২০৩৩ প্ল্যানেটারি সায়েন্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোবায়োলজি (2023 – 2033 Planetary Science and Astrobiology) দশকীয় সমীক্ষায় ইউরেনাস বিজ্ঞানকে অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে । বর্তমানে ইউরেনাস গ্রহকে নিয়ে অতিরিক্ত গবেষণা বা অধ্যয়ন চলছে এবং Webb এর বিজ্ঞান ক্রিয়াকলাপের প্রথম বছরে আরো অনেক কিছুর পরিকল্পনা করা হয়েছে ।
* তথ্যসূত্র: https://www.nasa.gov/ , https://edition.cnn.com/ , https://gizmodo.com/ , অন্তর্জাল ।
* চিত্র: https://www.nasa.gov/
মুহাম্মদ আস্রাফুল আলম (সোহেল)